সাময়িক প্রসঙ্গ
প্রচলিত ভ্রান্ত বিশ্বাস সফর মাস কি অশুভ এবং আখেরি চাহার শোম্বা কি?
আরাফাত ডেস্ক

 আমাদের সমাজে ‘আখেরি চাহার শোম্বা’ নামে একটি দিবস ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালিত হয়ে আসছে। দীন সম্পর্কে অজ্ঞ একদল অনুকরণপ্রিয় মুসলিম এ দিবসকে ইসলামী দিবস মনে করে বিভিন্ন ‘আমলও করে থাকেন। আরো দুঃখজনক হলো, এমন একটি ভিত্তিহীন দিবসকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশের অনেক জাতীয় দৈনিকেও এ সম্পর্কিত বিভিন্ন লেখা ছাপা হয় এবং মানুষকে এ দিবসের পবিত্রতা সম্পর্কে জানানো হয়। অথচ শরী‘আতের মানদ-ে এ দিবসের কোনো ভিত্তি নেই। অতএব এ দিবস কেন্দ্রিক ‘আমলের কোন প্রশ্নই আসে না। মূলতঃ এ দিবস ও দিবসসংক্রান্ত ‘আমলগুলো ‘মুকসুদুল মু’মিনীন’ কিংবা এ-জাতীয় কিছু বই-পুস্তকে পাওয়া যায়। যা নির্ভরযোগ্যতার মানদণ্ডে আদৌ টিকে না।

‘আখেরি চাহার শোম্বা’ কী?
‘আখেরী চাহার শোম্বা’ আরবী ও ফার্সি শব্দযুগলে গঠিত। প্রথম অংশ ‘আখেরী’ শব্দটি আরবী যার অর্থ ‘শেষ’ এবং দ্বিতীয় অংশ ‘চাহার শোম্বা’ ফার্সি যার অর্থ ‘চতুর্থ বুধবার’। ভিত্তিহীন বিভিন্ন কিতাবের বর্ণনা অনুসারে এ দিবস পালনের প্রেক্ষাপট হলো-
নাবী মুহাম্মদ (সা.)-কে এক ইয়াহূদী যাদু করেছিল। ফলে তিনি (সা.) অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এ যাদুর প্রভাবে তিনি মাসজিদেও যেতে পারেননি। কথিত আছে যে, সফর মাসের শেষ বুধবার নাবী (সা.) গোসল করেন এবং সুস্থ হয়ে মাসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করেন। এ গোসলই তাঁর জীবনের শেষ গোসল। নাবী (সা.)-এর সুস্থতার পরিপ্রেক্ষিতে সাহাবায়ে কিরাম খুশি হয়ে এ দিন রোযা রেখেছিলেন এবং নফল সালাত আদায় করেছিলেন। কাজেই উম্মাতের জন্যও এ দিন গোসল করে রোযা রেখে নফল সালাত আদায় করে আনন্দ প্রকাশ করা আবশ্যক!!
এরূপ ভ্রান্ত ‘আক্বীদাহ্ ও বিশ্বাস ধারণ করে আমাদের সমাজের কতিপয় মুসলিম অজ্ঞতাবশত হিজরী সফর মাসের শেষ বুধবারকে ‘আখেরী চাহার শোম্বা’ হিসেবে পালন করেন। এছাড়াও সফর মাসকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে আরো কিছু কুসংস্কারের প্রচলন আছে, যা ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ গ্রন্থ অবলম্বনে প্রদত্ত হলো-
অশুভ সফর মাস ও এ মাসের বালা-মুসিবত : প্রথমতঃ এটা জানা আবশ্যক যে, কোনো স্থান, সময়, বস্তু বা কর্মকে অশুভ, অযাত্রা বা অমঙ্গলময় বলে মনে করা ইসলামী ‘আক্বীদাহ্-বিশ্বাসের ঘোর পরিপন্থী একটি কুসংস্কার। এখানে লক্ষণীয় যে, আরববাসীরা জাহেলী যুগ থেকে ‘সফর’ মাসকে অশুভ ও বিপদাপদের মাস বলে বিশ্বাস করত। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের এ কুসংস্কারের প্রতিবাদ করে বলেন :
لَا طِيَرَةَ، وَلَا هَامَةَ وَلَا صَفَرَ.
“...কোনো অশুভ-অযাত্রা নেই, কোনো ভুত-প্রেত বা অতৃপ্ত আত্মা নেই এবং সফর মাসের অশুভত্বের কোনো অস্তিত্ব নেই...।”[১]
অথচ এর পরেও মুসলিম সমাজে অনেকের মধ্যে পূর্ববর্তী যুগের এ সকল কুসংস্কার থেকে গেছে। এ সকল কুসংস্কারকে উস্কে দেয়ার জন্য অনেক বানোয়াট কথা হাদীসের নামে বানিয়ে সমাজে প্রচার করেছে মিথ্যুকরা। এ সকল জাল ও বানোয়াট কথার মধ্যে রয়েছে- এ (সফর) মাস বালা-মুসিবতের মাস। এ মাসে এত লক্ষ এত হাজার... বালা নাযিল হয়। এ মাসেই আদম ('আ.) ফল খেয়েছিলেন। এ মাসেই হাবীল নিহত হন। এ মাসেই নূহের কাওম ধ্বংস হয়। এ মাসেই ইব্রাহীম ('আ.)-কে আগুনে ফেলা হয়। ...এ মাসের আগমনে রাসূলুল্লাহ (সা.) ব্যথিত হতেন। এ মাস চলে গেলে তিনি (সা.) খুশি হতেন- তিনি বলতেন :
مَنْ بَشَّرَنِيْ بِخُرُوْجِ صَفَرٍ بَشَّرْتُهُ بِالْجَنَّةِ (بِدُخُوْلِ الْجَنَّةِ).
“যে ব্যক্তি আমাকে সফর মাস অতিক্রান্ত হওয়ার সুসংবাদ প্রদান করবে, আমি তাকে জান্নাতে প্রবেশের সুসংবাদ প্রদান করব”[২] ইত্যাদি অনেক কথা এই মিথ্যুকরা বানিয়েছে। আর অনেক সরলপ্রাণ মুসলিম তাদের এ সকল জালিয়াতপূর্ণ কথাকে বিশ্বাস করে নিয়েছেন। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, সফর মাসের অশুভত্ব ও বালা-মুসিবত বিষয়ক সকল কথাই জাল, ভিত্তিহীন ও মিথ্যা।
সফর মাসের প্রথম রাতের সালাত : উপর্যুক্ত মিথ্যা কথাগুলোর ভিত্তিতেই এ মাসে ভিত্তিহীন ‘সালাতের’ উদ্ভাবন করা হয়েছে। বলা হয়েছে- কেউ যদি সফর মাসের প্রথম রাতে মাগরিবের পরে... বা ‘ইশার পরে.. চার রাক‘আত সালাত আদায় করে, অমুক অমুক সূরা বা আয়াত এতবার পাঠ করে... তবে সে বিপদ থেকে রক্ষা পাবে, এত পুরস্কার পাবে... ইত্যাদি। এগুলো সবই ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা, যদিও অনেক সরলপ্রাণ ‘আলেম ও বুযুর্গ এগুলো বিশ্বাস করেছেন বা তাদের বইয়ে বা ওয়াযে উল্লেখ করেছেন।[৩]
সফর মাসের শেষ বুধবার : বিভিন্ন জাল হাদীসে বলা হয়েছে, বুধবার অশুভ এবং যে কোনো মাসের শেষ বুধবার সবচেয়ে অশুভ দিন। আর সফর মাস যেহেতু অশুভ, সেহেতু সফর মাসের শেষ বুধবার বছরের সবচেয়ে বেশি অশুভ দিন এবং এ দিনে সবচেয়ে বেশি বালা-মুসিবত নাযিল হয়। এ সব ভিত্তিহীন কথাবার্তা অনেক সরলপ্রাণ দীনদার মানুষ বিশ্বাস করে নিয়েছেন। যেমন- “সফর মাসে একলাখ বিশ হাজার ‘বালা’ নাযিল হয় এবং সবদিনের চেয়ে ‘আখেরী চাহার শোম্বা’তে (সফর মাসে শেষ বুধবার) নাযিল হয় সবচেয়ে বেশি। সুতরাং ঐ দিনে যে ব্যক্তি নিম্নোক্ত নিয়মে চার রাকাআত নামায আদায় করবে আল্লাহ তাকে ঐ বালা থেকে রক্ষা করবেন এবং পরবর্তী বছর পর্যন্ত তাকে হিফাজতে রাখবেন...।”[৪]
এগুলো সবই জাল ও ভিত্তিহীন কথা। তবে আমাদের দেশে ‘আখেরী চাহার শোম্বা’র প্রসিদ্ধি এ কারণে নয়, অন্য কারণে। প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সফর মাসের শেষ দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি সফর মাসের শেষ বুধবারে কিছুটা সুস্থ হন এবং গোসল করেন। এরপর তিনি পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এ অসুস্থতাতেই তিনি পরের মাসে ইন্তিকাল করেন। এজন্য মুসলিমগণ এ দিনে তাঁর সর্বশেষ সুস্থতা ও গোসলের স্মৃতি উদযাপন করেন।
এ বিষয়ক প্রচলিত কাহিনীর সার-সংক্ষেপ প্রচলিত একটি পুস্তক থেকে উদ্ধৃত করছি- “হযরত নাবী করীম (সাঃ) দুনিয়া হইতে বিদায় নিবার পূর্ববর্তী সফর মাসের শেষ সপ্তাহে ভীষণভাবে রোগে আক্রান্ত হইয়া ছিলেন। অতঃপর তিনি এই মাসের শেষ বুধবার দিন সুস্থ হইয়া গোসল করতঃ কিছু খানা খাইয়া মসজিদে নববীতে হাযির হইয়া নামাযের ইমামতী করিয়াছিলেন। ইহাতে উপস্থিত সাহাবীগণ অত্যধিক আনন্দিত হইয়াছিলেন। আর খুশীর কারণে অনেকে অনেক দান খয়রাত করিয়াছিলেন। বর্ণিত আছে, আবু বকর (রাঃ) খুশীতে ৭ সহস্র দীনার এবং হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) ৫ সহস্র দীনার, ওসমান (রাঃ) ১০ সহস্র দীনার, হযরত আলী (রাঃ) ৩ সহস্র দীনার এবং আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) ১০০ উট ও ১০০ ঘোড়া আল্লাহর ওয়াস্তে দান করিয়াছিলেন। তৎপর হইতে মুসলমানগণ সাহাবীগণের নীতি অনুকরণ ও অনুসরণ করিয়া আসিতেছে। হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর এই দিনের গোসলই জীবনের শেষ গোসল ছিল। ইহার পর আর তিনি জীবিতকালে গোসল করেন নাই। তাই সকল মুসলমানের জন্য এই দিবসে ওজু-গোসল করতঃ ইবাদৎ বান্দেগী করা উচিৎ এবং নবী করীম (সাঃ) এর প্রতি দরূদ শরীফ পাঠ করতঃ সাওয়াব রেছানী করা কর্তব্য...।”[৫]
উপরের এ কাহিনীটিই কমবেশি সমাজে প্রচলিত ও বিভিন্ন গ্রন্থে লেখা রয়েছে। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেও কোনো সহীহ বা য‘ঈফ হাদীসে এ ঘটনার কোনো প্রকারের উল্লেখ/বর্ণনা পাইনি। হাদীস তো দূরের কথা কোনো ইতিহাস বা জীবনী গ্রন্থেও আমি এ ঘটনার কোনো উল্লেখ পাইনি। ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া অন্য কোনো মুসলিম সমাজে ‘সফর মাসের শেষ বুধবার’ পালনের রেওয়াজ বা এ কাহিনী প্রচলিত আছে বলেও আমার জানা নেই।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সর্বশেষ অসুস্থতা : রাসূল (সা.) সফর বা রবিউল আউয়াল মাসের কত তারিখ থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কত তারিখে ইন্তিকাল করেন সে বিষয়ে হাদীস গ্রন্থে কোনোরূপ উল্লেখ বা ইঙ্গিত নেই। অগণিত হাদীসে তাঁর অসুস্থতা, অসুস্থতাকালীন অবস্থা, কর্ম, উপদেশ, তাঁর ইন্তিকাল ইত্যাদি ঘটনা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোথাও কোনো ভাবে কোনো দিন-তারিখ বলা হয়নি।
দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে ‘আলেমগণ রাসূল (সা.)-এর জীবনের ঘটনাবলী ঐতিহাসিক দিন-তারিখ সহকারে সাজাতে চেষ্টা করেন। তাঁর অসুস্থতার শুরু সম্পর্কে অনেক মত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী ঐতিহাসিক ইবনু ইসহাক (১৫১ হি/৭৬৮ খৃ.) বলেন :
اُبْتُدِئَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ بِشَكْوَاهُ الَّذِيْ قَبَضَهُ اللهُ فِيْهِ... فِيْ لَيَالٍ بَقِيْنَ مِنْ صَفَرٍ، أَوْ فِيْ أَوَّلِ شَهْرِ رَبِيْعِ الْأَوَّلِ.
“রাসূলুল্লাহ (সা.) যে অসুস্থতায় ইন্তিকাল করেন, সে অসুস্থতার শুরু হয়েছিল সফর মাসের শেষে কয়েক রাত থাকতে, অথবা রবিউল আউয়াল মাসের শুরু থেকে।”[৬]
কি বার থেকে তাঁর অসুস্থতার শুরু হয়েছিল, সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন শনিবার, কেউ বলেছেন বুধবার এবং কেউ বলেছেন সোমবার তার অসুস্থতা শুরু হয়।[৭] কয়দিনের অসুস্থতার পরে তিনি ইন্তিকাল করেন, সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, ১০ দিন, কেউ বলেছেন, ১২ দিন, কেউ বলেছেন ১৩ দিন, কেউ বলেছেন, ১৪ দিন অসুস্থ থাকার পরে রাসূল (সা.) ইন্তিকাল করেন।[৮]
পরবর্তী আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পাব যে, তিনি কোন তারিখে ইন্তিকাল করেছিলেন, সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন ১ রবিউল আউয়াল, কেউ বলেছেন ১২ রবিউল আউয়াল তিনি ইন্তিকাল করেছেন ইত্যাদি।
সর্বাবস্থায়, কেউ কোনোভাবে বলছেন না যে, অসুস্থতা শুরু হওয়ার পরে মাঝে কোনো দিন তিনি সুস্থ হয়েছিলেন। অসুস্থ অবস্থাতেই ইন্তিকালের কয়েকদিন আগে তিনি গোসল করেছিলেন বলেও সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম বুখারী সংকলিত হাদীসে ‘আয়িশাহ্ (রাযী.) বলেন :
إِنَّ رَسُولَ اللهِ ﷺ لَمَّا دَخَلَ بَيْتِيْ وَاشْتَدَّ بِهِ وَجَعُهُ قَالَ هَرِيْقُوْا عَلَيَّ مِنْ سَبْعِ قِرَبٍ... لَعَلِّي أَعْهَدُ إِلَى النَّاسِ (لَعَلِّى أَسْتَرِيْحُ فَأَعْهَدُ إِلَى النَّاسِ)... ثُمَّ خَرَجَ إِلَى النَّاسِ، فَصَلَّى لَهُمْ وَخَطَبَهُمْ.
“রাসূল (সা.) যখন আমার ঘরে প্রবেশ করলেন এবং তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেল, তখন তিনি বললেন, তোমরা আমার উপরে ৭ মশক পানি ঢাল...; যেন আমি আরাম বোধ করে লোকদের নির্দেশনা দিতে পারি। তখন আমরা এভাবে তাঁর দেহে পানি ঢাললাম...। এরপর তিনি মানুষদের কাছে বেরিয়ে যেয়ে তাদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করলেন এবং তাদের উদ্দেশে খুতবাহ্ প্রদান বা ওয়ায করলেন।”[৯]
এখানে সুস্পষ্ট যে, রাসূল (সা.) তাঁর অসুস্থতার মধ্যেই অসুস্থতা ও জ্বরের প্রকোপ কমানোর জন্য এভাবে গোসল করেন, যেন কিছুটা আরাম বোধ করেন এবং মাসজিদে গিয়ে সবাইকে প্রয়োজনীয় নসীহত করতে পারেন।
এ গোসল করার ঘটনাটি কত তারিখে বা কী বারে ঘটেছিল তা হাদীসের কোনো বর্ণনায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। তবে আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানী সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমের অন্যান্য হাদীসের সাথে এ হাদীসের সমন্বয় করে উল্লেখ করেছেন যে, এ গোসলের ঘটনাটি ঘটেছিল ইন্তিকালের আগের বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ- ইন্তিকালের ৫ দিন আগে।[১০] অর্থাৎ- ১২ রবিউল আউয়াল ইন্তিকাল হলে তা ঘটেছিল ৮ রবিউল আউয়ালে।
উপরের আলোচনা থেকে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, সফর মাসের শেষ বুধবারে রাসূল (সা.) এর সুস্থ হওয়া, গোসল করা এবং এজন্য সাহাবীগণের আনন্দিত হওয়া ও দান-সাদাক্বাহ্ করার এ সকল কাহিনীর কোনোরূপ ভিত্তি নেই; বরং সর্বৈব মিথ্যা। ওয়াল্লাহু আ‘লাম।
যেহেতু মূল ঘটনাটিই প্রমাণিত নয়, সেহেতু সে ঘটনা উদযাপন করা বা পালন করার প্রশ্নই ওঠে না। এরপরেও আমাদের বুঝতে হবে যে, কোনো আনন্দের বা দুঃখের ঘটনায় আনন্দিত বা দুঃখিত হওয়া এক কথা, আর প্রতি বছর সে দিনে আনন্দ বা দুঃখ প্রকাশ করা বা ‘আনন্দ দিবস’ বা ‘শোক দিবস’ উদযাপন করা সম্পূর্ণ অন্য কথা। উভয়ের মধ্যে আসমান-যমীনের পার্থক্য।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনে অনেক আনন্দের দিন বা মুহূর্ত এসেছে, যখন তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন, শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে সাজদাহ্ করেছেন। কোনো কোনো ঘটনায় তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবীগণও আনন্দিত হয়েছেন ও বিভিন্নভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু পরের বছর বা পরবর্তী কোনো সময়ে সে দিন বা মুহূর্তকে তারা বাৎসরিক ‘আনন্দ দিবস’ হিসেবে উদযাপন করেননি। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশ বা সাহাবীদের কর্ম ছাড়া এরূপ দিন বা মুহূর্ত পালন বা এগুলোতে বিশেষ ‘ইবাদত করা কিংবা বিশেষ সাওয়াবের কারণ বলে মনে করার কোনো সুযোগ নেই।
আখেরি চাহার শোম্বার নামায : উপরের আলোচনা থেকে আমার জানতে পেরেছি যে, সফর মাসের শেষ বুধবারের কোনো প্রকার বিশেষত্ব হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। এ দিনে কোনোরূপ ‘ইবাদত, সালাত, সিয়াম, যিক্র, দু‘আ, দান-সাদাক্বাহ্ ইত্যাদি পালন করলে অন্য কোনো দিনের চেয়ে বেশি বা বিশেষ কোনো সওয়াব বা বরকত লাভ করা যাবে বলে ধারণা করা ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা। এজন্য আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী লিখেছেন যে, সফর মাসের শেষ বুধবারে যে বিশেষ নফল সালাত বিশেষ কিছু সূরা, আয়াত ও দু‘আ পাঠের মাধ্যমে আদায় করা হয়, তা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।[১১]

 টীকা :

[১] বুখারী- ৫/২১৫৮, ২১৬১; মুসলিম- ৪/১৭৪২-১৭৪৫।
[২] সাগানী, আল-মাউদূ‘আত- পৃঃ ৬১; মোল্লা ক্বারী, আল-আসরার- পৃঃ ২২৫; তাহির পাটনী, তাযকিরা- পৃঃ ১১৬; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩০৯; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৫৩৯; নিযামুদ্দীন আউলিয়া, রাহাতুল মুহিববীন- পৃঃ ১০১; রাহাতুল কুলুব- পৃঃ ১৩৮।
[৩] খাজা নিযামুদ্দীন আউলিয়া, রাহাতুল কুলুব- পৃঃ ১৩৮-১৩৯; মুফতী হাবীব সামদানী, বার চান্দের ফযীলত- পৃঃ ১৪।
[৪] খাজা নিযামুদ্দীন আউলিয়া, রাহাতিল কুলুব- পৃঃ ১৩৯।
[৫] মুফতী হাবীব সামদানী, বার চান্দের ফযীলত- পৃঃ ১৫।
[৬] ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ আন-নববিয়্যাহ- ৪/২৮৯।
[৭] কাসতালানী, আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ, আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া- ৩/৩৭৩; যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব- ১২/৮৩।
[৮] কাসতালানী, আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ, আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া- ৩/৩৭৩; যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব- ১২/৮৩।
[৯] আস-সহীহ- ১/৮৩, ৪/১৬১৪, ৫/২১৬০; হাকিম, আল-মুস্তাদরাক- ১/২৪৩; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ- ১৪/৫৬৬।
[১০] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী- ৮/১৪২।
[১১] আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার- পৃঃ ১১১।

আপনার মন্তব্য1

ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:39:54 সূর্যাস্ত : 5:44:41

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত