সাময়িক প্রসঙ্গ
সম্পাদকীয়
শাইখ মুহাম্মাদ হারুন হুসাইন

কুরবানীর তাৎপর্য ও শিক্ষাঃ কুরবানী একটি ত্যাগ ও ঈমান দীপ্ত ‘আমলের নাম। যা যুগ পরম্পরায় এযাবৎকাল সুচারুরূপে এবং ঈমানী ভাব গাম্ভীর্যে সমেত সু—প্রতিষ্ঠা পেয়ে আসছে। আল্লাহ তা‘আলা এ গুরুত্বপূর্ণ ‘ইবাদতটি সর্বযুগে সব উম্মতের উপর জারি রেখেছেন। ধরন ও প্রকৃতি কিংবা পদ্ধতির ভিন্নতা থাকতে পারে; কিন্তু মহান আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার ও তার সান্নিধ্যে পেঁৗছার মাধ্যম হিসাবে কুরবানী অতি তাৎপর্যপূর্ণ ‘আমল। এটি হতে পারে সময়, শ্রম ও অর্থ ত্যাগ এর মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য প্রত্যাশা। আদম (‘আ.)—এর পুত্রদ্বয় হাবিল ও কাবিল কুরবানীর আদেশ প্রাপ্ত হয়ে তা বাস্তবায়ন করেছিলেন। তাদের একজনের কুরবানী মহান আল্লাহর দরবারে গৃহীত হওয়ার প্রমাণ মিললে অপরজন অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েন। তখন একনিষ্ঠ ঈমানদার অপর ভ্রাতা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন : আল্লাহ তা‘আলা তো কেবল মুত্তাকিদের কাছ থেকেই কবুল করে থাকেন। এর অর্থ দাঁড়ায় কুরবানী হচ্ছে তাক্বওয়ার পরীক্ষা। সেজন্য আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন : তোমাদের কুরবানীর পশুর রক্ত ও মাংস আমার কাছে পেঁৗছায় না; পেঁৗছায় কেবল তাক্বওয়া বা আল্লাহ ভীতি।

মানুষের মধ্যে দু’টি স্বভাব রয়েছে। একটি হচ্ছে মনুষ্যত্ব আর অপরটি হচ্ছে পশুত্ব। মনুষ্যত্বের চর্চা এবং বিকাশ একান্ত কাম্য। পশুত্বের উপরে মনুষ্যত্বের বিজয় স্মর্তব্য। যারা মহান আল্লাহর দরবারে হাজির হওয়াকে ভয় করে এবং প্রবৃত্তির তাড়না হতে নিজেকে নিবৃত রেখে পবিত্র জীবন—যাপন করতে পারে, তারাই কেবল মনুষ্যত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে বিবেচিত হবে। আর এরূপ ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তা‘আলা উত্তম পারিতোষিক হিসাবে জান্নাতকে সুসজ্জিত করে রেখেছেন। পক্ষান্তরে যে অহংকারী হবে এবং দুনিয়াবী সুখ—স্বাচ্ছন্দকে অগ্রাধিকার দেবে, সে পশুত্বের স্বভাবে সংক্রমিত এবং এর পরিণতিস্বরূপ জাহান্নামই হবে তার ঠিকানা। তাই তো আল্লাহ তা‘আলা আত্মশুদ্ধি অর্জনের প্রতি সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বারবার সংযমশীল হতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং এমন কিছু ‘আমল আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন, যার মাধ্যমে আমরা তাক্বওয়াবান হতে পারি। এসব সুযোগের মধ্যে অন্যতম কুরবানী।

কুরবানী হতে হবে প্রিয় বস্তু। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “তোমরা কখনো কল্যাণ লাভ করতে পারবে না যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করবে।” সেজন্য ইব্রাহীম (‘আ.) আদিষ্ট হয়েছিলেন কলিজার টুকরা সন্তান ইসমা‘ঈলকে কুরবানী করতে- যখন প্রস্তুত হলেন, আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ ত্যাগ ও প্রস্তুতিকে গ্রহণ করে তার বিনিময়ে পশু কুরবানীর বিধান জারি করলেন এবং বলে দিলেন- ইব্রাহীম! তুমি তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছ। পুত্রকে আর জবাই করতে হবে না। এই নাও, একটি পশু, তা কুরবানী করো। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলে দিলেন- “কুরবানীর ধারাবাহিকতা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বলবৎ থাকবে।”

আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.) নিজে কুরবানী করেছেন। কুরবানীর নির্দেশ দিয়েছেন। তার স্ত্রীগণ করেছেন, পরবর্তীতে সাহাবায়ে কিরাম করেছেন এবং আজও পর্যন্ত এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে। মনে রাখতে হবে যে, প্রিয় নবী (সা.) কুরবানীর গুরুত্ব বুঝাতে তার বিদায় হজ্জে মিনা উপত্যকায় একশত উট নাহর করেছিলেন। এর মাধ্যমে উম্মতকে বুঝিয়ে দিলেন যে, কুরবানী মহান আল্লাহর প্রিয় একটি ‘ইবাদত। যেন এ ব্যাপারে কেউ কার্পণ্য না করে। এমনকি এও বলে দিলেন যে, যার সামর্থ্য আছে অথচ কুরবানী করেনি, সে যেন আমাদের ঈদের সালাতে না আসে। তার এই উক্তির মাধ্যমে এ কথাও প্রমাণিত যে, সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা কুরবানী না করলে এটি একটি অকল্যাণকর এবং বিধি বহির্ভূত কর্ম বলে বিবেচিত হবে। এজন্য একদল আলেম কুরবানী করাকে ওয়াজিব মনে করেন। আবার কেউ কেউ এটিকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বলে আখ্যা দেন।

মোদ্দাকথা, কুরবানী একটি তাৎপর্যপূর্ণ ‘ইবাদত। সামর্থ্যবান কোনো মুসলিমের জন্য এ নিয়ে কোনো অবহেলা করা কিছুতেই সমীচীন নয়। কুরবানীর দিনে মুসলিম নর—নারী ঈদুল আযহার সালাত আদায় করতে উন্মুক্ত ময়দানে সমবেত হবেন, সালাত আদায় করবেন, খুতবাহ্ মনোযোগ দিয়ে শুনবেন, মুসলিমদের বিশাল জামা‘আত প্রত্যক্ষ করবেন এবং দু‘আয় শামিল হবেন। অতঃপর নিজ অবস্থানস্থলে ফিরে এসে শরিয়ত নির্ধারিত পশু কুরবানী করবেন। এ সময়ে কুরবানীদাতা প্রত্যেক মুসলিম মহান আল্লাহর নাম নেবেন, তাকবীর ধ্বনি দেবেন এবং মহান আল্লাহর দেওয়া তাওফীক অনুসারে উৎসর্গকৃত কুরবানী যেন আল্লাহ তা‘আলা কবুল করেন সে প্রার্থনায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখবেন। একই সাথে হবে মহান আল্লাহর নাম, তাকবীর ও প্রার্থনা। কতই না সুন্দর ‘ইবাদত! পৃথিবীর সর্বত্র মুসলিম একই নিয়মে ‘ইবাদত পালন করবেন। ঘোষিত হবে সর্বত্র তাওহীদের নিনাদ, মুখরিত হবে মুসলিম সমাজের অলিগলি তাকবির ধ্বনিতে। কি সুন্দর! কি ভাব গাম্ভীর্যপূর্ণ এক আবহ! যা ভাষায় ব্যক্ত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

মানুষের মাঝে কুরবানীর এই ‘ইবাদত যেমন মহান আল্লাহর একত্ববাদকে স্মরণ করিয়ে দেয়, তেমনি মহান আল্লাহর নিয়ামত ভোগ করার সুবাদে মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতায় নিজেকে নিয়োজিত করতে উদ্বুদ্ধ করে। আর আল্লাহ তা‘আলা কৃতজ্ঞ বান্দাদের পছন্দ করেন। তিনি বলে দিয়েছেন : তোমাদের রবের ঘোষণা- তোমরা যদি শুকরিয়া আদায় করো, তাহলে আমি বাড়িয়ে দেব। পক্ষান্তরে যদি অকৃতজ্ঞ হও, তাহলে জেনে রাখো আমার শাস্তি বড়ই কঠিন। কুরবানীর মাধ্যমে একজন মুসলিম যেমন তার তাওহীদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে, তেমনি মহান আল্লাহর দেওয়া এ জিয়াফত গ্রহণ করে পরিবার পরিজনসহ পাড়া—প্রতিবেশী ও হতদরিদ্র সর্বশ্রেণীর মানুষকে পর্যাপ্ত পরিমাণ মাংস খাওয়ার সুযোগ করে দেবে। এতে তার হৃদয়ের প্রশস্ততা প্রমাণিত হবে এবং আল্লাহ তা‘আলা খুশি হবেন। যাদের কুরবানী এ লক্ষ্যে সম্পাদিত হবে তারাই সার্থক ও সফল মুসলিম। আমরা সাপ্তাহিক আরাফাত পরিবারবর্গ আসন্ন কুরবানীর আমেজকে তাওহীদী চেতনায় জাগ্রত করার একান্ত আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে মুসলিম উম্মাহকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও স্বাগত জানাচ্ছি। আল্লাহ তা‘আলা আপনাদের ও আমাদের নেক ‘আমলকে কবুল করুন -আমীন।


সাপ্তাহিক আরাফাতঃ বর্ষ : ৬৪, সংখ্যা : ৩৭-৩৮


আপনার মন্তব্য

ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:17:45 সূর্যাস্ত : 5:11:51

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত