দারসুল কুরআন
দারসুল কুরআন
শাইখ মুহাম্মাদ হারুন হুসাইন
আল্লাহ তা‘আলার বাণী
﴿وَإِذَا قِيْلَ لَهُمۡ ءَامِنُوْا بِمَآ أَنزَلَ ٱللهُ قَالُوْا نُؤۡمِنُ بِمَآ أُنزِلَ عَلَيۡنَا وَيَكۡفُرُوْنَ بِمَا وَرَآءَهُۥ وَهُوَ ٱلۡحَقُّ مُصَدِّقٗا لِّمَا مَعَهُمۡۗ قُلۡ فَلِمَ تَقۡتُلُوْنَ أَنۢبِيَآءَ ٱللهِ مِن قَبۡلُ إِنْ كُنْتُمْ مُّؤۡمِنِيْنَ وَلَقَدۡ جَآءَكُم مُّوْسٰى بِٱلۡبَيِّنَٰتِ ثُمَّ ٱتَّخَذۡتُمُ ٱلۡعِجۡلَ مِنْۢ بَعۡدِهِۦ وَأَنتُمۡ ظَٰلِمُوْنَ وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِيْثَٰقَكُمۡ وَرَفَعۡنَا فَوۡقَكُمُ ٱلطُّوْرَ خُذُوْا مَآ ءَاتَيۡنَٰكُمْ بِقُوَّةٖ وَٱسۡمَعُوْاۖ قَالُوْا سَمِعۡنَا وَعَصَيۡنَا وَأُشۡرِبُوْا فِيْ قُلُوْبِهِمُ ٱلۡعِجۡلَ بِكُفۡرِهِمۡۚ قُلۡ بِئۡسَمَا يَأۡمُرُكُمْ بِهِۦٓ إِيْمَٰنُكُمۡ إِنْ كُنْتُمْ مُّؤۡمِنِيْنَ﴾সরল অর্থানুবাদ
“আর যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তাতে ঈমান আনো; তারা বলে- আমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে আমরা বিশ্বাস করি। অথচ পরবর্তী কিতাবকে (কুরআন) তারা প্রত্যাখ্যান করে, যদিও তা সত্য এবং যা তাদের নিকট আছে তার সমর্থক। বলো, যদি তোমরা বিশ্বাসী ছিলে তবে কেন তোমরা পূর্বে নাবীদেরকে হত্যা করেছিলে? আর নিশ্চয়ই মূসা তোমাদের নিকট স্পষ্ট প্রমাণসহ এসেছে, তারপরেও তোমরা যালীম সেজে গো-বৎসকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছিলে। স্মরণ করো, যখন তোমাদের শপথ নিয়েছিলাম এবং তুর পর্বতকে তোমাদের ঊর্ধ্বে তুলেছিলাম এবং বলেছিলাম, যা দিলাম তা দৃঢ়রূপে ধারণ করো এবং শ্রবণ করো। তারা বলেছিল, আমরা শুনলাম ও অমান্য করলাম। কুফ্রীর কারণে তাদের অন্তরে গো-বৎস প্রীতি শিকড় গেড়ে বসেছিল। বলো, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও, তবে তোমাদের বিশ্বাস যার নির্দেশ দেয়, তা কতই না নিকৃষ্ট।”[১]
দারসের বিষয়বস্তু
বিভ্রান্ত ইয়াহূদী জাতির স্বভাজাত রীতি আদর্শের কথা আলোচিত হয়েছে। তারা জেনে-বুঝে সত্য পত্যাখ্যানকারী ও প্রতারক। নিজেদেরকে ঈমানদার দাবী করেও সর্বশেষ ও চূড়ান্ত আসমানী কিতাব আল-কুরআনকে অস্বীকার করছে। মহান আল্লাহর ভায়বহ গজব দেখেও তারা তাদের বক্র নীতি হতে চুল পরিমান সরে আসেনি; বরং ধৃষ্টতা দেখিয়ে বলছে- আমরা শুনলাম কিন্তু মানলাম না। তাদের এ গোঁড়ামী ও এক রোখা নীতি তাদেরকে ক্রমশঃ ভ্রষ্টতায় নিক্ষেপ করছে। আর এর পরিণাম বড়ই গর্হিত ও নিন্দনীয়। পরিতাপের বিষয় হলো-ইয়াহূদীদের এ বক্র নীতি কোনো না কোনোভাবে আমাদের মাঝেও সংক্রমিত হচ্ছে। আমরা সর্বশেষ ওয়াহী আল-কুরআন ও চূড়ান্ত নাবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর অনুসারী বলে দাবীদার হয়েও একগেয়েমীর কারণে সরল পথ থেকে বিচ্যুত হতে চলেছি। আমাদেরকে দুনিয়ার মোহজাল আবেষ্টিত করে ফেলছে। ফলে কুরআন-হাদীস বুঝেও আমরা বিভ্রান্তিতে পড়ে যাচ্ছি কিংবা নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ন্যায় ও নীতি বাক্য বিষর্জন দিয়ে আমিত্তের অশ্ব পিঠে চাবুক মেরে দিগ্ভ্রান্ত ধোসর মরুর ধুলায় নিজেকে হারিয়ে ফেলছি। জানি না, এ জাতীর কে লাগাম টেনে ধরবে?
প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা
মহান আল্লাহর বাণী :
﴿بِمَآ أَنزَلَ ٱللهُ﴾
অর্থ : “আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন।”
এ আয়াত দ্বারা বুঝায় সর্বশেষ ও চূড়ান্ত আসমানী কিতাব ‘আল-কুরআন’।
মহান আল্লাহর বাণী :
﴿بِمَا وَرَآءَهُ﴾
“যা তার পরবর্তী।”
এ আয়াত দ্বারা তাওরাত পরবর্তী কিতাব ইঞ্জিল বিশেষতঃ কুরআন উদ্দেশ্য।
মহান আল্লাহর বাণী :
﴿فَلِمَ تَقۡتُلُوْنَ أَنۢبِيَآءَ ٱللهِ مِنْ قَبۡلُ﴾
“তবে কেন তোমরা পূর্বে নাবীদেরকে হত্যা করেছিলে।”
এ আয়াতাংশ দ্বারা মাদীনার ইয়াহূদেরকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, যদি তোমরা নিজেদেরকে ঈমানদার বলেই দাবী করো, তাহলে কেন নাবী-রাসূলগণকে হত্যা করেছিলে? বাহ্যতঃ এটি আমাদের নাবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর নবুওয়াতকালে বর্তমান ইয়াহূদীদেরকে বলা হয়েছে; অথচ তারাতো পূর্বেকার নাবী হত্যায় জড়িত ছিলোনা। আসলে এর দ্বারা তাদের বাপ-দাদার কৃত কর্মের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া উদ্দেশ্য। এটা এ কারণে যে, তারা ‘তাওরাতের’ অনুসারী দাবী করে যেন নিজেরা ঐ সময়ের হত্যাকা-কে সমর্থণ করেছে। নচেৎ তারা সর্ব শেষ আসমানী কিতাব আল-কুরআনের প্রতি ঈমান এনে বাপ-দাদার কৃত অপরাধকে প্রত্যাখ্যান করতো।
মহান আল্লাহর বাণী :
﴿ثُمَّ ٱتَّخَذۡتُمُ ٱلۡعِجۡلَ مِنۢ بَعۡدِهِ﴾
“তার পরেও তোমরা গো-বৎসকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছিলে।”
এর দ্বারা উদ্দেশ্য মহান আল্লাহকে বাদ দিয়ে সামেরী কর্তৃক নির্মিত গরুর বাচ্চার আকৃতির মূর্তিকে ‘ইলাহ’ বা মা‘বূদ হিসেবে উপসনা করা।
মহান আল্লাহর বাণী :
﴿وَأَنتُمۡ ظَٰلِمُوْنَ﴾
অর্থ : “এ অবস্থায় যে, তোমরা ছিলে যালিম।”
জেনে-বুঝে যার পাওনা তাকে তা না দিয়ে অন্যকে দেওয়া হলো যুল্ম। আর ইয়াহূদীরা মহান আল্লাহর ‘ইবাদত বাদ দিয়ে সেই জায়গায় হাতে তৈরী গো-বৎসের মূর্তির উপসনা করল। এটা মহান আল্লাহর হক্বের বেলায় প্রকাশ্য যুল্ম ছাড়া আর কি? তাইতো আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে যালিম হিসেবে আখ্যা দিলেন।
মহান আল্লাহর বাণী :
﴿وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِيْثَٰقَكُمۡ﴾
“স্মরণ করো, যখন তোমাদের শপথ নিয়েছিলাম।”
আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য ইয়াহূদীদের কাছ থেকে আল্লাহ তা‘আলা এ মর্মে অঙ্গীকার নিয়ে ছিলেন যে, তারা তাদের প্রতি নাযিল হওয়া ‘তাওরাত’ অনুযায়ী ‘আমল করবে। সর্বশেষ কুরআন নাযিল করে তা মানতে নির্দেশ দিয়ে তাদের পূর্বের ওয়া‘দা ভঙ্গের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। যাতে তারা অনুতপ্ত হয় এবং কুরআনের প্রতি ঈমান আনে। কিন্তু হঠকারী ইয়াহূদী তাও প্রত্যাখ্যান করে কাফিরই থেকে গেল।
মহান আল্লাহর বাণী :
﴿وَرَفَعۡنَا فَوۡقَكُمُ ٱلطُّوْرَ﴾
“এবং ত্বুর পর্বতকে তোমাদের ঊর্ধ্বে তুলেছিলাম।”
ইয়াহূদীদেরকে সতর্ক ও সাবধান করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা মূসা ('আ.)-এর মাধ্যমে কয়েকটি আশ্চর্য্য ঘটনা ঘটিয়ে ছিলেন, যাতে তারা ভয় পায় এবং সত্য গ্রহণ করে নেয়। তার মধ্যে ওদের উপর ত্বুর পর্বত উঁচিয়ে ধরা অন্যতম। ইমাম ইবনু কাসীর (রহ.) বলেন : বানী ইস্রা-ঈল থেকে আল্লাহ তা‘আলা ওয়া‘দা নিয়েছিলে যে, তারা তাওরাত মানবে, তাওহীদে বিশ্বাসী হবে এবং মহান আল্লাহর হুকুম-আহ্ক্বাম মেনে চলবে। কিন্তু তারা তা অস্বীকর করলো, তখন আল্লাহ তা‘আলা পাহাড়কে আদেশ দিলেন। ফলে পাহাড় ওদের উপর ঝুলে পড়লো। মনে হলো যেন ওদের উপর পড়ে সকলকে ধ্বংস করে দেবে। তখন ভয়ে ভীত হয়ে সাজদায় লুটিয়ে পড়লো এবং এক পাশ দিয়ে দেখতে লাগলো পাহাড় তাদের উপর পড়ে কি-না তা। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা এ বিপদ দূর করে ওদের মাথার উপর থেকে পাহাড়কে সরিয়ে নিলেন।[২]
অতঃপর সর্বনাশা স্বভাবদুষ্ট ইয়াহূদী কৃত ওয়া‘দা প্রত্যাখ্যান করে আগের অবস্থানে ফিরে গেল এবং বলল : “আমরা শুনলাম ও অমান্য করলাম।”
মহান আল্লাহর বাণী :
﴿وَأُشۡرِبُوْا فِيْ قُلُوْبِهِمُ ٱلۡعِجۡلَ بِكُفۡرِهِمۡۚ﴾
“কুফ্রীর কারণে তাদের অন্তরে গো-বৎস প্রীতি শিকড় গেড়ে বসেছিলো।”
এ আয়াতাংশ দ্বারা একথা বুঝানো হয়েছে যে, কুফ্রী এমন একটি বিষাক্ত শরাব, যা তাদেরকে নিশাগ্রস্থ করে ফেললো। ফলে গো-বৎস পুজার প্রীতি তাদের অন্তরে মিক্সার হয়ে গেঁথে গেলো।[৩]
আর এটাই হলো নাফরমানীর কুফল। ক্বাদাতাদা (রাযি.) বলেন : মূর্তি পুঁজার প্রীতি তাদের অন্তরে ঢেলে দেওয়া হয় ফলে সেটি তাদের অন্তসমূহে নিখাঁদভাবে স্থান করে নেয়।[৪]
যাদের অন্তর বাঁকা, তারা বাঁকা পথকেই বেঁছে নেয় এবং সে পথেই আত্মতৃপ্তি পায়। নিশাগ্রস্থ ব্যক্তি যেমন নিজেকে সুস্থ মনে করে এবং সুস্থ মানুষকে পাগল ভাবে; ঠিক তেমনি বাঁকা হৃদয়ের অধিকারী মানুষ সর্বদা নিজেকে যোগ্য ও ফিট মনে করে এবং যোগ্য মানুষকে অযোগ্য করে রাখার নীল-নকশা আঁটে। এ জন্য প্রবাদে আছে- ‘কখনো যোগ্যতা অযোগ্য বিবেচনার কারণ’।
মহান আল্লাহর বাণী :
﴿بِئۡسَمَا يَأۡمُرُكُم بِهِۦٓ إِيْمَٰنُكُمۡ﴾
“তোমাদের বিশ্বাস যার নির্দেশ দেয়, তা কতই না নিকৃষ্ট।”
এ আয়াতাংশের মর্ম হচ্ছে- যে বিশ্বাস মনুষকে মুশরিক করে রাখে এবং মহান আল্লাহর ‘ইবাদত বাদ দিয়ে তাঁর কোনো তুচ্ছ সৃষ্টির গোলাম বানিয়ে ফেলে, এর চেয়ে নিকৃষ্ট ও নিন্দনীয় অপরাধ আর হতে পারে না। তাওরাতের প্রতি বিশ্বাসের দাবীই কি (?) তাদেরকে গো-বৎসে পূজারী বানিয়ে দিলো![৫]
এ জন্যতো আল্লাহ তা‘আলা শিরককে সবচেয়ে বড় যুল্ম বা অবিচার বলে অভিহিত করেছেন।[৬]
ইয়াহূদীদের কাছে প্রেরিত মু’জিযাহ্সমূহ
আল্লাহ তা‘আলা নাবী ও রাসূলগণকে মু’জিযাহ্ দ্বারা সাহায্য করেছেন। আর মু’জিযাহ্ হলো স্বাভাবিক অভ্যাস ব্যতিত অলৌকিক কিছু ঘটানো। এ কাজ আল্লাহ তা‘আলা করে সত্য অস্বীকারকারীকে অক্ষম করে দেন। যাদের ভাগ্যে হিদায়াত আছে, তারা তা দেখে নাবী ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনে। আর যারা হতভাগা, তারা মিথ্যার আবর্তে ঘোরপাক খেতে থাকে এবং সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে। আল্লাহ তা‘আলা বানী ইস্রা-ঈল তথা ইয়াহূদীদেরকে মু’জিযাহ্ দ্বারা সতর্ক করে ছিলেন, তা উল্লেখ করে বলেন :
﴿وَلَقَدۡ ءَاتَيۡنَا مُوْسٰى تِسۡعَ ءَايَٰتِۭ بَيِّنَت...ۖ﴾
“আমি মূসাকে নয় (৯)টি স্পষ্ট নিদর্শন দিয়েছিলাম...।”[৭]
এ নয়টি মু’জিযাহ্ বা নিদর্শন হলো- তুফান দিয়ে ভীত করা, পঙ্গপাল পাঠিয়ে ফসল নষ্ট করা, কুম্মাল অর্থ উঁকুন হলেও এখানে কটন থেকে নির্গত এক প্রকার পোঁকা উদ্দেশ্য যা তাদের সংরক্ষিত ফসল খেয়ে শুধু খোসা রেখেছিল, অসংখ্য-অগণিত ব্যাংঙ পাঠিয়ে এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন যে থালা-বাসন, পানপাত্র সর্বত্র ব্যাঙের ছড়াছড়ি ওদেরকে একেবাবে অতিষ্ট করে তুলেছিল, মুখ দিয়ে রক্তের লালা বের হওয়া যা পানির বদলে রক্তের পরিণত হয়ে ওদের জীবন যায়যায় অবস্থা করেছিল, মূসা ('আ.)-এর লাঠি যা রাখলেই সাপে পরিণত হত, মূসা ('আ.)-এর ডান হাত বগলের নীচে রেখে বের করলে উজ্জল আলো হত এবং আবার বগলের নীচে হাত রাখলে আলো বন্ধ হয়ে যেত, সমুদ্রে রাস্তা করে দেওয়া এবং অনাবৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষ দ্বারা পরীক্ষায় ফেলা।[৮]
কিন্তু এসব মু’জিযাহ্ দেখেও তারা সত্য পথে আসেনি; বরং কুফ্রীতে সীমালঙ্গন করেছে।
আবর মুশরিকদের বৈশিষ্ট্য
ইয়াহূদীদের বাড়াবাড়ি ও নাফরমানীর রোগ আরব মুশরিকদের মাঝেও ছড়িয়ে ছিলো। তাদেরকে যখন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) তাওহীদের দা‘ওয়াত দিলেন এবং সাহাবাগণের ন্যায় ঈমান আনতে আহ্বান জানালেন, তখন তারাও ইয়াহূদীদের ন্যায় ধৃষ্টতা দেখিয়ে বলেছিলো-
﴿وَإِذَا قِيْلَ لَهُمۡ تَعَالَوۡاْ إِلَىٰ مَآ أَنزَلَ ٱللهُ وَإِلَى ٱلرَّسُوْلِ قَالُوْا حَسۡبُنَا مَا وَجَدۡنَا عَلَيۡهِ ءَابَآءَنَآۚ﴾
“তাদেরকে যখন বলা হয় আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে এসো, তখন তরা বলে, আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে যে পথের অনুসারী পেয়েছি, সে পথই আমাদের জন্য যথেষ্ট।”[৯]
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿وَإِذَا قِيْلَ لَهُمُ ٱتَّبِعُوْا مَآ أَنزَلَ ٱللهُ قَالُوْا بَلۡ نَتَّبِعُ مَا وَجَدۡنَا عَلَيۡهِ ءَابَآءَنَآۚ أَوَلَوۡ كَانَ ٱلشَّيۡطَٰنُ يَدۡعُوْهُمۡ إِلَىٰ عَذَابِ ٱلسَّعِيْرِ﴾
“তাদেরকে যখন বলা হয়- আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা অনুসরণ করো, তখন তারা বলে- বরং আমরা তরাই অনুসরণ করবো আমদের বাপ-দাদাকে যে পথ অনুসরণ করতে দেখেছি। শয়ত্বান যদি তাদেরকে জলন্ত আগুণের দিকে ডাকে, তবুও কি (তারা তারই অনুসরণ করবে)?”[১০]
পক্ষান্তরে প্রকৃত মু‘মিনের বৈশিষ্ট্য হলো- সত্য শুনবে এবং আনুগত্য করবে; কোনো প্রকার বাঁকা পথ অবলম্বন করবে না। সালাফ তথা সাহাবাগণের এ মহৎ গুণের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿وَقَالُوْا سَمِعۡنَا وَأَطَعۡنَاۖ﴾
“আর তারা বলে- আমরা শুনেছি এবং মেনে নিয়েছি।”[১১]
আফসোস! বর্তমানে কিছু মুসলিমদের -চাই সাধারণ মুসলিম বা ‘আলেম- তাদের আচরণ আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলে। সামান্য দুনিয়াবী স্বার্থ-চাই সেটা অর্থ-সম্পদ, সম্মান বা নেতৃত্ব-কর্তৃত্তের লড়াই হোক না কেন- সে সবের মোহ আমাদেরকে আষ্টে-পিষ্টে ধরে রাখে এবং আমরা সালাফী দাবীদার হয়েও সালাফগণের নীতি ও আদর্শ হতে বিচ্যুত হয়ে পড়ি। হায়! যদি আমরা মহান আল্লাহকে ভয় করতাম এবং পরকালে জবাবদেহিতার কথা স্মরণ করতাম।
দারসের শিক্ষাসমূহ
১. মহান আল্লাহর সর্ব শেষ ও চূড়ান্ত ওয়াহীর প্রতি ঈমান আনা ও সে অনুযায়ী ‘আমল করার মাঝেই প্রকৃত কল্যাণ নিহিত।
২. কুরআন বিগত আসমানী কিতাবসমূহের সত্যায়ণকারী গ্রন্থ, যার প্রতি ঈমান আনা ব্যতিত কোনো ব্যক্তি মু‘মিন-মুসলিম বলে দাবী করতে পারবে না।
৩. পূর্বসূরীরা যদি ভুল পথের উপর থাকে, আর তাদের অনুসারীরা সে পথ ছেড়ে না আসে, তাহলে তারা পূর্বসূরীদের ভুলের অনুসারী বলে বিবেচ্য হবে এবং তাদেরকে একই খেসারত দিতে হবে।
৪. সত্য জানার পরও বাঁকা পথ অবলম্বন করা ইয়াহূদী ও আরব মুশরিকদের বৈশিষ্ট্য। পক্ষান্তরে সালাফগণের নীতি ও আদর্শ হলো- সত্য জানা ও সে অনুযায়ী ‘আমল করা।
৫. অন্যকে উপদেশ দেওয়া সহজ; কিন্তু নিজের জীবনে সত্যের বাস্তবায়ন বড়ই কঠিন। যাঁরা এ কঠিন কাজ করতে পারবে অর্থাৎ- যাঁদের ভিতর ও বাহির এক হবে, তাঁরাই প্রকৃত সফলকাম মানুষ।
উপসংহর
নীতি ও আদর্শ বিসর্জন দাতা ব্যক্তি বা গোষ্ঠি নিজেরা বিপথগামী হয় এবং অপরকেও বিভ্রান্ত করে। বিগত জাতিসমূহের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে জাগ্রত বিবেক দ্বারা পরিচালিত না হলে ভবিষ্যৎ বড়ই অন্ধকার। নীতি কথা পুঁথিতে না রেখে বাস্তবতায় ময়দানে নিঃসংকোচে চর্চা হওয়া দরকার। আল্লাহ আমাদেরকে সত্য উপলব্ধি করার এবং সকল প্রকার গোঁড়ামী পরিহার করে সরল মনে সত্য পথে সু-প্রতিষ্ঠিত থাকার তাওফীক্ব দিন -আমীন।
[১]. সূরাহ্ আল বাক্বারাহ্ ২ : ৯১-৯৩।
[২]. মুহাম্মাদ নাসীব আর-রেফ‘ঈ ‘তাইসীরুল ‘আলিইল ক্বাদীর’ মাকতাবাতুল মা‘আরিফ- রিয়াদ : ১/৬৩।[৩]. ড. ওয়াহবা আয-যুহাইলী ‘আত্ তাফসীর আল-মুনীর’ দারুল ফিকহ- দামেস্ক : ১/২৪৯।
[৪]. মুহাম্মাদ নাসীব আর-রেফ‘ঈ ‘তাইসীরুল ‘আলিইল ক্বাদীর’ মাকতাবাতুল মা‘আরিফ- রিয়াদ : ১/৭৭-৭৮।
[৫]. ড. ওয়াহবা আয-যুহাইলী ‘আত-তাফসীর আল-মুনীর’ দারুল ফিকহ- দামেস্ক : ১/২৪৮।
[৬]. সূরাহ্ লুক্বমা-ন ৩১ : ১৩।
[৭]. সূরাহ্ ইস্রা/বানী ইস্রা-ঈল : ১০১।
[৮]. ড. ওয়াহবা আয-যুহাইলী ‘আত-তাফসীর আল-মুনীর’ দারুল ফিকহ- দামেস্ক : ১/২৪৯।
[৯]. সূরাহ্ আল মায়িদাহ্ ৫ : ১০৪।
[১০]. সূরাহ্ লুক্বমান ৩১ : ২১।
[১১]. সূরাহ্ আল বাক্বারাহ্ ২ : ২৮৫।
ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:17:45
সূর্যাস্ত : 5:11:51
আপনার মন্তব্য