সাময়িক প্রসঙ্গ
বাস্তবতা ও ন্যায্যতার আলোকে বাবরি মাসজিদের রায়!
মুহাম্মদ আমীনুল ইসলাম

[২য় কিস্তি]
কারা এ মামলা লড়ছে?
এ বিশেষ মামলাটি লড়ছে ৩টি পক্ষ। এর মধ্যে দু’টি হিন্দু ও একটি মুসলিম পক্ষ। মুসলিম পক্ষে লড়ছে মুসলিম ওয়াকফ বোর্ড ভারতে ইসলামিক স¤পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এ বোর্ডের। অন্যদিকে হিন্দু পক্ষরা হলো- ডানপন্থি রাজনৈতিক দল হিন্দু মহাসভা ও হিন্দু সন্ন্যাসীদের সংস্থা নির্মোহী আখড়া। ১৯৯২ সালে বাবরি মাসজিদ ভাঙার ১০ বছর ২০০২ সালে এলাহাবাদের উচ্চ আদালতে অযোধ্যার ওই জায়গাটি নিয়ে মামলা করে এ তিন পক্ষ। পরবর্তীতে ২০১০ সালে ওই মামলার রায় দেওয়া হয়। রায়ে বাবরি মাসজিদের ২.৭৭ একর জায়গা তিন পক্ষের মধ্যে সমান তিন ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়। আদালত জানান, ওই জায়গাটি তিন ভাগে বিভক্ত করা উচিত। মুসলিম সম্প্রদায় এর তৃতীয় অংশটি পাবে। বাকি দুই অংশের মধ্যে মূল যে অংশে বাবরি মাসজিদ ছিল, সেটি পাবে হিন্দু মহাসভা। সে সময় আদালত এ সংক্রান্ত ৩টি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণও দেন। আদালত বলেন, ওই জায়গাটি রামের জন্মস্থান। সেখানে একটি হিন্দু মন্দির গুড়িয়ে মাসজিদ নির্মাণ করা হয় এবং প্রকৃত ইসলামি অনুশাসন মেনে বাবরি মাসজিদ নির্মাণ করা হয়নি। পরবর্তীতে ২০১১ সালে হিন্দু-মুসলিম সব পক্ষই ওই রায় প্রত্যাখ্যান করে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করে।[১]
সুপ্রিম কোর্টের রায় : বাবরি মাসজিদ আর রাম জন্মভূমি নিয়ে বিতর্ক কয়েক শতাব্দী ধরে। এ নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বারে বারে দাঙ্গা হয়েছে। ব্রিটিশ সরকার ভেতরের অংশটা মুসলিমদের আর বাইরে চত্ত্বরটা হিন্দুদের ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৪৯ সালে মাসজিদের ভেতরে কে বা কারা রামের মূর্তি রেখে দেয়। মুসলিমরা তখনই প্রতিবাদ করেন এবং সরকার জমিটিকে বিতর্কিত ঘোষণা করে তালা বন্ধ করে দেয়। জমির মালিকানা কার সেটা ঠিক করতে সে বছরই আদালতে প্রথম মামলা হয়। এরপর ফৈজাবাদের জেলা আদালত ১৯৮৬ সালে তালা খুলে হিন্দুদের পূজোর অনুমতি দেন। আর তখন থেকেই রামজন্মভূমি আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। ফৈজাবাদের জেলা আদালত ১৯৮৬ সালে তালা খুলে হিন্দুদের পূজোর অনুমতি দেন। আর তখন থেকেই রামজন্মভূমি আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। ২০১০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট নির্দেশ দেয় যে বিতর্কিত জমিটি তিনভাগ হবে দু’ভাগ পাবেন হিন্দুরা আর এক ভাগ পাবে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড। তার বিরুদ্ধে সবপক্ষই সুপ্রীম কোর্টে যায় ২০১১ সালে। সুপ্রীম কোর্ট আদালতের বাইরে সব পক্ষকে নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করেছিল। কট্টরপন্থী হিন্দুরা দাবি করেন বাবরি মাসজিদের জায়গাতেই ভগবান রামের জন্ম হয়েছিল এবং একটি রামমন্দির ভেঙ্গে মোগল ‘আমলে সেখানে মাসজিদ তৈরি করা হয়েছিল। ভারতের বাবরি মাসজিদ মামলার রায়ের খবর ও মূল্যায়ন শুধু উপমহাদেশেই নয়, বিশ্ব মিডিয়াতেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই প্রকাশ হচ্ছে। এ নিয়ে বিরোধ সৃষ্টির ১৩৪ বছর পর এই মামলার রায় বের হলো।
৯ নভেম্বর ছুটির দিন কোর্ট বসিয়ে রায় ঘোষণা করা হলো এবং সবরকম দলীল-যুক্তির বাইরে গিয়ে একটি অস্বাভাবিক রায়ে ঐতিহাসিক বাবরি মাসজিদের জমি দিয়ে দেওয়া হলো হিন্দুদের মন্দির নির্মাণের জন্য। বিশ্লেষকরা বলেন, বাবরি মাসজিদ মামলার এই রায়টি হলো ভারতের মুসলমানদের প্রতি হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকারের তৃতীয় আঘাত। প্রথমে এনআরসির মাধ্যমে লাখ লাখ মুসলমানকে অ-ভারতীয় সাব্যস্ত করা হলো। আসাম থেকে শুরু করে এনআরসির এ ধারা এখন সারা ভারতজুড়েই চালু করার খবর পাওয়া যাচ্ছে এবং বিজেপি সভাপতি কট্টর হিন্দুবাদী অমিত শাহ-এর ঘোষণায় স্পষ্ট হয়েছে যে, তা একমাত্র মুসলমানদের জন্যই করা হচ্ছে। কারণ এনআরসিতে ক্ষতিগ্রস্ত অন্যদের ভিন্ন আইনে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়ে যাচ্ছেন। দ্বিতীয় আঘাত হলো, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিল করে সেই রাজ্যটিকে পুরোপুরি কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশেষায়িত রাজ্য কাশ্মীরকে খণ্ড-বিখণ্ড করে, প্রাদেশিক মর্যাদাও বিলুপ্ত করা হয়েছে। অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে সেখানকার মুসলমানদের। এই অবরুদ্ধতা নানা রূপে নানা মাত্রায় চালানো হচ্ছে সেখানে।
এখন শুনা যাচ্ছে, মুসলমানদের ওপর মোদি সরকারের চতুর্থ যে আঘাতটি আসতে যাচ্ছে সেটি হচ্ছে, মুসলিম পারসনাল ল বোর্ডকে বাতিল করে দিয়ে মুসলিম পারিবারিক আইন উঠিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ। পুরো ভারতজুড়ে অভিন্ন পারিবারিক আইন ও দ-বিধি প্রয়োগের পাঁয়তারা শুরু করেছে বিজেপি সরকার। আঘাত একের পর এক আসছেই ভারতের মুসলমানদের ওপর।
ভারতের প্রধান বিচারপতি গগৈ রায়দানের সময় যেসব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন তার মধ্যে রয়েছে, হিন্দুরা বিশ্বাস করেন এখানে রামের জন্মভূমি ছিল। তবে কারো বিশ্বাস যেন অন্যের অধিকার হরণ না করে। বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে জমির মালিকানা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তিনি জোর দিয়েছেন আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার রিপোর্টের ওপর। তারা বলেছে, মাসজিদের নিচে আরো একটি প্রাচীন কাঠামো ছিল। আর সেটা কোনো ইসলামি স্থাপত্য ছিল না। তবে বিচারপতি গগৈ এও বলেন, মাসজিদের নিচে যে কাঠামোর সন্ধান মিলেছিল তা যে কোনো মন্দিরেরই কাঠামো ছিল, পুরাতাত্ত্বিক বিভাগের রিপোর্টে তাও কিন্তু বলা হয়নি। গগৈ আরো বলেছেন, যদি বাবরি মাসজিদের নিচের কাঠামোটি কোনো হিন্দু স্থাপত্য হয়েও থাকে, তাহলেও এত দিন পর ওই জমিকে হিন্দুদের জমি হিসেবে মেনে নেয়া ঠিক হবে না। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আরো বলা হয়েছে, ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বাবরি মাসজিদে নিয়মিত নামায হয়েছে। এ সময় হিন্দুরা রাত্রিকালীন নামাযের পর মাসজিদের মিম্বরে যে রামলালা ও সীতার মূর্তি স্থাপন করে, সেটিও ছিল অন্যায় ও বেআইনি কাজ। এ ছাড়া ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর কথিত করসেবকদের হাতে বাবরি মাসজিদ ধ্বংস করাও ছিল বেআইনি। তবে বাবরি মাসজিদের মামলাধীন জমির ওপর রামলালার অধিকার স্বীকার করে নেয়া আইনশৃঙ্খলা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বহাল রাখার প্রশ্নের সাথে যুক্ত।[২]
মন্দির পক্ষের অনেকের বিশ্বাস ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেখানে বাবরি মাসজিদ দাঁড়িয়েছিল, ঠিক সেখানেই জন্ম হয়েছিল রামচন্দ্রের। সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে, মাসজিদ নির্মিত হয়েছিল অ-ইসলামি এক কাঠামোর উপর। একটানা ৪০ দিন শুনানি হওয়ার পরে রায় লেখার জন্য মাসখানেক সময় নেয় বেঞ্চ।[৩]
সংবিধান- শীর্ষ আদালকের রায়ের শুরুতেই রয়েছে সংবিধানের কথা। রায়ের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সাংবিধানিক মূল্যবোধ রাষ্ট্রের ভিত্তি এবং সে কারণেই ৪১ দিন ধরে এই আদালতে বিষয়টির আইনগত সমাধানের উদ্দেশ্যে শুনানি হয়েছে।
ধ্বংস- বাবরি মাসজিদ যখন ধ্বংস হয়েছিল, সে সময়ে উত্তর প্রদেশে বিজেপি সরকার ছিল, এবং কেন্দ্র ছিল পি ভি নরসীমা রাওয়ের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার। রায়ের ৯১৩-১৪ পাতায় লেখা হয়েছে, মাসজিদ ধ্বংস করা ছিল স্থিতাবস্থা এবং আদালতককে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ। মাসজিদ ধ্বংস করা এবং ইসলামিক সৌধ বিলোপ করা আইনের শাসনের গুরুতর লঙ্ঘন।
ন্যায়- রায়ে ন্যায় শব্দটি উল্লিখিত হয়েছে ১০১ বার। রায়ে ন্যায় স¤পর্কিত বিষয়ে আইনবিদদের লেখা থেকে উদ্ধৃতি তো দেওয়া হয়েছে, এমনকি সংবিধানের ১৪২ নং অনুচ্ছেদে ও উদ্ধৃত করা হয়েছে, যেখানে ন্যায় প্রসঙ্গ উল্লিখত হয়েছে।
বিশ্বাস- রায়ে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, সিদ্ধান্তের কেন্দ্রে রয়েছে প্রমাণাদি, বিশ্বাস নয়। তবে একটি ১১৬ পাতার অতিরিক্ত সংযুক্ত অংশে বিশ্বাসের প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তার শেষে বলা হয়েছে, ফলে শেষ পর্যন্ত হিন্দুদের বিশ্বাসমতে সেখানে মাসজিদ নির্মাণের আগেও ভগবান রামের জন্মস্থান ছিল, এবং সে বিশ্বাসের কথা বিভিন্ন নথি ও মৌখিক প্রমাণ থেকে প্রমাণিত হয়েছে। সরকার- স্থানীয় এক জমি সমস্যা সমকালীন ভারতের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার পিছনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে বিভিন্ন সরকার। এবং তা ঘটেছে ব্রিটিশ সরকারের ‘আমল থেকে, চলেছে ১৫০ বছরের বেশি সময় ধরে। ব্রিটিশরা বাবরির বাইরে এবং ভেতরে দেওয়াল তুলেছিল, রাজীব গান্ধী তালা খোলার নির্দেশ দিয়েছিলেন, আর ১৯৯৩ সালে নরসীমা রাও ৬৭.৭ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিলেন।
জমি- এই গোটা বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ২.৭৭ একর জমি। রায়ের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে অযোধ্যা শহরের ১৫০০ বর্গগজ জমির মালিকানা নিয়ে বিতর্কের কথা। বিতর্কিত জমি হিন্দুদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড অন্যত্র ৫ একর জমি পাবে।
নরেন্দ্র মোদী- বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ১৯৯০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর গুজরাটের সোমনাথ থেকে আদভানির নেতৃত্বে যে রথযাত্রা শুরু হয়েছিল তার অন্যতম সংগঠক। এ যাত্রা মাঝপথেই শেষ হয়ে যায় যখন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব সমস্তিপুরে আদভানিকে গ্রেফতারির নির্দেশ দেন। পরবর্তী বছরগুলোতে রামমন্দির বিজেপির জন সমর্থন বাড়াতে থেকেছে এবং ২০১৪ সালে ঢেউ তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেছেন মোদী।
নির্মোহী আখড়া- রামনন্দী ধারার এই আখড়া অন্যতম বড় ও শক্তিশালী আখড়া। দশকের পর দশক ধরে সমস্ত স্তরে ব্যাপকভাবে আইনি লড়াই চালিয়ে এসেছে তারা। ২০১০ সালে এলাহাবাদ কোর্ট এই আখড়াতে বিতর্কিত ২.৭৭ একরের এক তৃতীয়াংশ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য তাদের সেবায়েতের অধিকারের দাবিকে নাকচ করে দিয়েছে।[৪]
পুরাতাত্ত্বিকরা বলেছিলেন যে মাসজিদের নিচে একটি ঐতিহাসিক কাঠামোর সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে, সেটি মন্দির কিনা তা তারা বলতে পারেননি। সরকারি-উকিলকে আরো জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ৪০০০ বছর হলো সোনা আবিষ্কার হয়েছে, তো ৭০০০ বছর আগে সোনার লঙ্কা এল কোথা থেকে? স্বভাবতই মেলেনি এ প্রশ্নের জবাবও। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে বিতর্কিত স্থানে রাম মন্দির তৈরির অনুমতি চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন সুব্রহ্মণ্যম স্বামী। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ নেতৃত্বে অন্য বিচারপতিরা হলেন এস এ বোডবে, ওয়াই ভি চন্দ্রচূড়, অশোক ভূষণ ও এস আব্দুল নাজির এর আপিল বেঞ্চ। একটানা চল্লিশ দিন শুনানির পর এ রায় দিলো।
বাবরি মাসজিদের জমির মালিকানার পক্ষে সব ধরনের প্রমাণ সুপ্রিমকোর্ট স্বীকার করেছে। অযোধ্যায় ১৫২৮ সালে মাসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৯৪৯ সালের ২২-২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেখানে নিয়মিত নামায আদায়ের বিষয়টিও বিচারকরা স্বীকার করেছেন। হঠাৎ গত শতাব্দী থেকে হিন্দুত্ববাদী ভাবধারা পুনর্জাগরণে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে এই ইস্যু সামনে আনা হয়। এতে বিজেপি ও চরম হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো বেশ সুবিধা পেয়েছে।
দ্বিতীয়ত : আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার (এএসআই) খননের ফলে যে সব জিনিসপত্র পাওয়া গেছে, তাতে স্পষ্ট যে সেগুলো অনৈসলামিক। তবে এএসআই এ কথা বলেনি, যে তার নিচে মন্দিরই ছিল। সুতরাং রাম মন্দির থাকা দিবাস্বপ্নের মতো।
তৃতীয়ত : অযোধ্যার বাবরী মাসজিদ ধ্বংসের ঘটনা হিন্দুত্বকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অনন্য সুযোগ হিসেবে কাজ করেছে।
চতুর্থত : ১৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ সালে কেন্দ্রীয় সরকার মাসজিদ ধ্বংসের বিষয়টি তদন্ত করার জন্য অবসরপ্রাপ্ত উচ্চ আদালতের বিচারক মনমোহন সিং লিবারহানের নেতৃত্বে লিবারহান কমিশন গঠন করে। ১৬ বছরে ৩৯৯ বার বৈঠকের পর ২০০৯ সালের ৩০ জুন কমিশন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১,০২৯ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদন অনুসারে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের ঘটনা অপ্ররোচিত কিংবা অপরিকল্পিত ছিল না বলে প্রতিবেদন দেয়।[৫]
লক্ষ্যণীয় যে, ১৫২৮ সালে মুঘল সম্রাট বাবরের সেনাপতি মীর বাকি বাবরি মাসজিদ নির্মাণ করলেও ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত একে ঘিরে কোনোরকম বিতর্ক ছিল না। ১৮৮৫ সালে মহান্ত রঘুবর দাস ফৈজাবাদ জেলা আদালতে বাবরি মাসজিদের বাইরে চাঁদোয়া টাঙানোর আবেদন জানান যা আদলত কর্তৃক নাকচ হয়ে যায়। ব্রিটিশ আমল জুড়ে বাবরি মাসজিদ নিয়ে এটি ছাড়া আর কোন ইস্যু তৈরি হয়নি।
ভারত স্বাধীন হবার পর ১৯৫০ সালে রামলালার মূর্তিগুলোর পূজার অধিকারের আবেদন জানিয়ে ফৈজাবাদ জেলা আদালতে আবেদন করেন গোপাল শিমলা বিশারদ। মূর্তি রেখে দেওয়ার এবং পূজা চালিয়ে যাওয়ার জন্য মামলা করেন পরমহংস রামচন্দ্র দাসও। ১৯৫৯ সালে বাবরি মাসজিদের অধিকার চেয়ে মামলা করে নির্মোহী আখড়া। লক্ষ্যণীয় যে, হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলির পূর্বসূরী নথুরাম গডসে কর্তৃক গান্ধীকে হত্যার পর, নেহেরু ঘোষিত সেক্যুলার ভারতে এ গোষ্ঠীগুলি তখন নিজেদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছে।
ঐতিহাসিক বাবরি মাসজিদ মামলা চল্লিশ দিন টানা শুনানির পর রায় স্থগিত রেখেছিল ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। গতকাল ৮ নভেম্বর, শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে আদালতের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ৯ নভেম্বর, শনিবার স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টায় রায় ঘোষণা করবেন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ।
তবে ঐতিহাসিক এই রায়ের প্রধান ৯টি বিষয় হলো-
১. রায়ে বলা হয়েছে- বাবরি মাসজিদ কোনো খালি জমির উপর নির্মিত হয়নি। ভারতের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ বলেন, পুরাতত্ত্ব বিভাগ তাদের যে রিপোর্টে জানিয়েছিল, ওই বিতর্কিত জমিতে তার আগে একটি কাঠামো ছিল। যা সম্ভবত দ্বাদশ শতকে নির্মিত হয়েছিল। তবে মন্দিরই ছিল কিনা তা পুরাতত্ত্ব বিভাগ স্পষ্ট করে জানায়নি।
২. অযোধ্যায় মাসজিদের দাবি কেউ কখনও ছেড়ে দেয়নি। ৯২ সালে মাসজিদ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তারপর নামায পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে ঠিকই। কিন্তু মাসজিদের দাবি ছেড়ে দেওয়া হয়নি।
৩. রায়ে বলা হয়- মুসলমানদের কোনোভাবে বঞ্চিত করা উচিত হবে না। মাসজিদ নির্মাণের জন্য বিতর্কিত স্থান থেকে দূরে কিন্তু অযোধ্যাতেই পাঁচ একর জমি দিতে হবে সরকারকে। যাতে একটি ভব্য মাসজিদ সেখানে গড়ে তোলা যায়।
৪. বিতর্কিত জমির মালিকানা নিয়ে শিয়া ওয়াকফ বোর্ডের দাবি খারিজ করে দিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। একই সঙ্গে বলেছে, রাম লালা বিরাজমান কোনো আইনি ব্যক্তি নন। নির্মোহী আখড়াও তাই জমির মালিকানা দাবি করতে পারে না। তারা কেবল রক্ষণাবেক্ষণ করত।
৫. আপাতত জমির মালিকানা যাবে সরকারের হাতে। সরকার তিন মাসের মধ্যে একটি ট্রাস্টি বোর্ড তৈরি করবে।
৬. বিতর্কিত জমির ভেতরের চত্বর ট্রাস্টি বোর্ডের হাতে তুলে দিতে হবে। ওই ট্রাস্টি বোর্ডই ঠিক করবে তারা সেখানে কী নির্মাণ করবে।
৭. বিতর্কিত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা ও শান্তি বজায় রাখতে হবে ভারত সরকারকে।
৮. রাম মন্দির ন্যাস কমিটির ভূমিকাকেও গুরুত্ব দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। জমির মালিকানা নিয়ে নির্মোহী আখাড়ার দাবি খারিজ করলেও তাদেরকে সুপ্রিম কোর্ট প্রস্তাবিত ট্রাস্টের সদস্য করতে হবে।
৯. ভারতের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ জানান, সুপ্রিম কোর্টের রায় হলো সর্বসম্মত। রায় নিয়ে পাঁচজন বিচারপতি সহমত হয়েছেন।[৬]
মুসলিমদের নিকট হতে সুপ্রিম কোটের রায়ের নামে জোর করে মাসজিদ ছিনিয়ে নিয়ে সেইস্থলে মন্দির বানিয়ে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদকে জাহির করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং ভারতীয় ক্ষমতাসীন দল তাদের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে একে রাজনীতির ঘুটি বানিয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তার চাইতে বড় যালেম আর কে আছে যে মহান আল্লাহর মাসজিদসমূহে তাঁর নাম উচ্চারণ করতে বাধা দেয় এবং সেগুলোকে বিরান করার চেষ্টা চালায়? অথচ তাদের জন্য সেখানে প্রবেশ করা বিধেয় ছিল না ভীত অবস্থায় ব্যতীত। তাদের জন্য দুনিয়ায় রয়েছে লাঞ্ছনা এবং আখিরাতে রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি[৭]। হে আল্লাহ! তুমি যালিমদের থেকে ভারতীয় মুসলিমদের এ মাসজিদ রক্ষা করো -আমীন!


[১]https://www.banglanews24.com/international/news/bd/।
[২] http : / / www.dailynayadiganta.com / sub editorial / 456102/%E0%A।
[৩] ttps://sylhetvoice.com/%E0%A6%AC%E0%A6%BE।
[৪] https : / / bengali.indianexpress.com / explained / ayodhay – judgement – ram – mandir -construction-babri-masjid-demolition-supreme-court।
[৫] https://www.thedailycampus.com/mukto_column/।
[৬] https://www.be.bangla.report/post/45380-ceR0J2BxA।
[৭] সূরাহ্ আল বাক্বারাহ্ ২ : ১১৪।


আপনার মন্তব্য

ঢাকায় সূর্যোদয় : 5:43:02 সূর্যাস্ত : 6:09:54

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত