সাময়িক প্রসঙ্গ
প্রচলিত শবে মি‘রাজ প্রসঙ্গ
শাইখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ খান মাদানী
ইসরা ও মি‘রাজের পরিচয় : ইস্রা আরবী শব্দ, অর্থ হলো রাত্রি বেলা ভ্রমণ করা। ইসলামী পরিভাষায় নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বিশেষ মু‘জিযাহ্স্বরূপ তাঁকে মাসজিদে হারাম এর চত্বর হতে মাসজিদে আকসা পর্যন্ত রাত্রিবেলায় জিবরা-ঈলের সাথে বিশেষ বাহনে জাগ্রতাবস্থায় যে ভ্রমণ করানো হয় তাকে ইস্রা বলা হয়।
মি‘রাজ শব্দটিও আরবী, অর্থ হলো উর্ধ্বগমনের মাধ্যম, যা উর্ধ্বগমন অর্থেও ব্যবহৃত হয়। ইসলামী পরিভাষায় নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাসজিদে আকসা হতে সপ্ত আসমান ও তদুর্ধ্বে স্বশরীরে জাগ্রতাবস্থায় আরোহণ এবং বিভিন্ন নিদর্শন পরিদর্শন করার যে মু’জিযাহ্ লাভ করেন তাকেই মি‘রাজ বলা হয়।[১]
ইস্রা, মি‘রাজের সত্যতা ও মু‘জিযা : ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন, নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নবুওয়াত লাভের পর স্বশরীরে আত্মা ও দেহসহ জাগ্রতাবস্থায় একই রাত্রে ইস্রা ও মি‘রাজ সংঘটিত হয়। এটাই অধিকাংশ বিদ্বানের মত ও এটাই বিশুদ্ধ মত।[২]
আল্লাহ তা‘আলা ইস্রা সম্পর্কে বলেন :
﴿سُبْحَانَ الَّذِىْ أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الأَقْصَى﴾
“পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছেন মাসজিদে হারাম হতে মাসজিদে আকসা পর্যন্ত।”[৩]
তিনি মি‘রাজ সম্পর্কে বলেন :
﴿وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَى ۞ عِندَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى ۞ عِندَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَى ۞ إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا يَغْشَى ۞ مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَى ۞ لَقَدْ رَأَى مِنْ آيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَى﴾
“নিশ্চয় সে তাকে আরেকবার দেখেছিল সিদরাতুল মুন্তাহার নিকটে, যার কাছে অবস্থিত বসবাসের জান্নাত, যখন বৃক্ষটি যা দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়ার, তদ্বারা আচ্ছন্ন ছিল, তাঁর দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি এবং সীমালঙ্ঘন করেনি। নিশ্চয় সে তার পালনকর্তার মহান নিদর্শনাবলী অবলোকন করেছে।”[৪]
এ হলো আল কুরআনের ভাষ্য, আর সহীহুল বুখারী-সহীহ মুসলিমসহ অসংখ্য সহীহ হাদীসে নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ইস্রা ও মি‘রাজের ইতিবৃত্ত বর্ণিত হয়েছে যা এক দীর্ঘ আলোচনা।
মোটকথা, ইস্রা ও মি‘রাজ ছিল বাস্তব স্বশরীরে ও জাগ্রতাবস্থায়, যা মহান আল্লাহর পক্ষ হতে নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জন্য এক বিশেষ মু‘জিযাহ্ এবং এটা হলো তাঁর নবূওয়াত ও রিসালাতের সত্যতা প্রমাণের এক বলিষ্ঠ দলীল।
প্রচলিত শবে মি‘রাজ উদযাপন : হিজরী বর্ষের রজব মাস এলেই সে মাসের একটি রাত বা গোটা মাসকে কেন্দ্র করে একশ্রেণীর মুসলিম শবে মি‘রাজের (মি‘রাজের রাতের) নামে নানা রকম আনন্দোৎসব, মনগড়া ‘ইবাদাত-বন্দেগী, ওয়াজ-মাহফিল, খাজা বাবার সিন্নি বিতরণ, চাঁদাবাজি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, সে সকল মুসলিম এবং তাদের ‘আলিম মুরশিদরা একটুও চিন্তা করলেন না যে, এ প্রচলিত শবে মি‘রাজ উদযাপনের কোন ভিত্তি আছে কি-না?
তাই সচেতন মুসলিম সমাজের খিদমাতে বলতে চাই, আসুন! আমরা একটু চিন্তা করি, যদি সত্যিই ইসলামে এর কোন অস্তিত্ব থাকে, তবে নিশ্চয় এ ‘ইবাদত পালন করলে আমরা পুণ্যের অধিকারী হব। আর যদি এর ভিত্তি না থাকে, তবে নিশ্চয় এটি ‘ইবাদতের নামে প্রচলিত এক ভ্রান্ত বিদ‘আত যা মানুষকে জান্নাতের পথ হতে সরিয়ে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাবে (নাঊযুবিল্লাহ মিন যালিক)।
এক্ষণে আসুন! আমরা প্রচলিত শবে মি‘রাজের দিন-তারিখের সত্যতা এবং মি‘রাজকে কেন্দ্র করে সালাত, সিয়াম ইত্যাদি ‘ইবাদতের বিশুদ্ধতা কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে পর্যালোচনা করি।
মি‘রাজের দিন তারিখ : পূর্বের আলোচনা হতে প্রমাণিত হয় যে, ইস্রা ও মি‘রাজ একটি সুপ্রসিদ্ধ ঘটনা যা কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত- এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু ইস্রা ও মি‘রাজ কোন দিন, মাস ও বছরে সংঘটিত হয়েছে- এ ব্যাপারে কুরআন ও সহীহ হাদীসে স্পষ্ট ও অস্পষ্ট কোনরূপই বক্তব্য না থাকায় বিদ্বানগণ বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন : নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নবূওয়াত লাভের পূর্বেই মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছে, কিন্তু এটা যথার্থ নয়। তবে অধিকাংশ বিদ্বানই বলেছেন : নবূওয়াত লাভের পরেই মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছে। এখন নবূওয়াতের কোন বর্ষে, মাসে ও দিনে সংঘটিত হয়েছে- এ নিয়ে আবার একাধিক মতামত পাওয়া যায়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য মতসমূহ সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনাসহ নিম্নে আলোকপাত করা হলো-
১। নবূওয়াত লাভের বছরই মি‘রাজ সংঘটিত হয়।
২। নবূওয়াত লাভের পাঁচ বছর পর মি‘রাজ সংঘটিত হয়।
৩। নবূওয়াতের দশম বছরে রজব মাসের ২৭শে রাত্রিতে।
৪। হিজরতের এক বছর পূর্বে অর্থাৎ- নবূওয়াতের ১২তম বছরে রবিউল আউয়াল মাসের ২৭শে রাত্রিতে।
৫। হিজরতের আট মাস পূর্বে রামাযান মাসের ২৭শে রাত্রিতে।
৬। হিজরতের ছয় মাস পূর্বে।
৭। হিজরতের এক বছর ও দুই মাস পূর্বে মুর্হারাম মাসে।
৮। হিজরতের এক বছর ও তিন মাস পূর্বে যিলহাজ্জ মাসে।
৯। হিজরতের এক বছর পাঁচ মাস পূর্বে শাওয়াল বা রামাযান মাসে।
১০। হিজরতের পূর্বে রজব মাসের প্রথম শুক্রবার রাতে। ইত্যাদি আরো একাধিক মতামত পাওয়া যায়।[৫]
সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা : উপরোক্ত মতামতসমূহ হতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, ইস্রা ও মি‘রাজ সংঘটিত হওয়ার রাতটির তারিখ নির্ধারিতভাবে কারো জানা নেই, কেননা এর বিশুদ্ধ কোন প্রমাণ নেই।
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ইমাম ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন, যে হাদীসে বলা হয়েছে যে, ইস্রা ও মি‘রাজ রজব মাসের ২৭শে রাত্রিতে সংঘটিত হয়েছে তা সঠিক নয়; বরং এর কোন ভিত্তি নেই।[৬]
ইমাম আবূ শামাহ (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন : “অনেক আলোচক বলে থাকেন যে, ইস্রা ও মি‘রাজ রজব মাসে সংঘটিত হয়েছে; মূলতঃ এটা হাদীস শাস্ত্রের পণ্ডিতদের কাছে এক ডাহা মিথ্যা কথা।”[৭]
যুগশ্রেষ্ঠ ইমাম শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ্ (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন, “মি‘রাজ সংঘটিত হওয়ার মাস, দশক বা নির্ধারিত দিনের কোন অকাট্য প্রমাণ নেই।”[৮]
অতএব সমাজে প্রচলিত যে মতের উপর ভিত্তি করে শবে মি‘রাজ উদযাপন করা হয় সে মতটি হলো নবূওয়াতের দশম বছরে রজব মাসের ২৭শে রাত্রিতে। আমরা প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ইমামদের বক্তব্য অনুযায়ী অবগত হলাম যে, উক্ত মতটি সঠিক নয়; বরং মিথ্যা। ইমামগণের বক্তব্য ছাড়াও আমরা যদি ইতিহাসের নিরিখে প্রমাণ করতে যাই, তবুও সে মতটি ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয়। কারণ আমরা জানি, মি‘রাজের রাতেই পাঁচ ওয়াক্ত সালাত র্ফয হয়েছে, আর ইতিহাস প্রমাণ করে যে, খাদীজাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হা) যখন ইন্তিকাল করেন তখন পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয হয়নি, তিনি ইন্তিকাল করেন নবুওয়াতের দশম বছরে রামাযান মাসে। তাহলে কীভাবে সে রামাযান মাসের দু’মাস পূর্বে রজব মাসে মি‘রাজ সংঘটিত হতে পারে। সুতরাং সমাজে প্রচলিত শবে মি‘রাজ উদযাপনের রাত বা মাসটি কুরআন ও সহীহ হাদীস এবং প্রকৃত ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী এক বানোয়াট মিথ্যা তারিখ ছাড়া কিছুই না। আর দিন-তারিখই যদি সঠিক বলে প্রমাণিত না হয়, তাহলে এর উপর ভিত্তি করে ‘ইবাদাতে লিপ্ত হওয়া কি প্রবৃত্তির অনুসরণ এবং বোকামির পরিচয় নয়?
শবে মি‘রাজের বিদ‘আতী ‘ইবাদাত : সমাজে প্রচলিত শবে মি‘রাজকে কেন্দ্র করে রজব মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সালাত (নামায), সিয়াম (রোযা), মিলাদ-মাহফিল, রাত্রি জাগরণ, আনন্দোৎসব, খাজা বাবার সিন্নি বিতরণ ইত্যাদি রকমারী ‘ইবাদতের আবিষ্কার হয়েছে এবং এক শ্রেণীর কাজ্জাব মিথ্যুক বহু রকমের জাল হাদীস ও কিস্সা কাহিনী তৈরী করে মানুষকে বিপথে নেয়ার অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
আসুন, আমরা কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে এসব ‘ইবাদতের সত্যতা যাচাই করে দেখি।
১। সালাতুর রাগাইব : রজব মাসকে কেন্দ্র করে যে বিশেষ সালাত আদায় করা হয়, তন্মধ্যে অন্যতম হলো ‘সালাতুর রাগাইব’। আনাস (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হু)-এর বরাত দিয়ে নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হতে বর্ণনা করে বলা হয়, যে ব্যক্তি রজব মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার রোযা রেখে মাগরিব ও ‘ইশার মাঝে দুই দুই করে বারো রাক‘আত সালাত পড়বে- প্রতি রাক‘আতে সূরা আল ফাতিহাহ্, অতঃপর সূরা আল কাদ্র তিনবার এবং সূরা আল ইখলা-স বারোবার- এভাবে সালাত শেষে সত্তরবার দরূদ পাঠ করবে এবং বিশেষ মুনাজাত করবে, তাহলে এ সালাত তার কবরে এসে তাকে যাবতীয় বিপদ মুসিবত হতে উদ্ধার করবে...। (নাঊযুবিল্লাহ)
ইমাম গায্যালী (রাহিমাহুল্লা-হ)-এর মতো ব্যক্তি তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন এ (১/২০২-২০৩) বলেন : এ সালাতের নাম হলো রজবের সালাত, এটা মুস্তাহাব- যদিও ঈদ ও তারাবীর সালাতের মতো এটা প্রমাণিত নয়, কিন্তু ফিলিস্তিনবাসীদেরকে গুরুত্ব সহকারে এটা আদায় করতে দেখে আমি এ সালাতের উপস্থাপন করা ভাল মনে করছি।
মূলতঃ এসব ব্যক্তির এরূপ বক্তব্য ও গ্রন্থই মানুষকে বিদ‘আতের দিকে ধাবিত করার জন্য যথেষ্ট। কারণ এ সালাত সম্পর্কিত বর্ণনাগুলো সকল মুহাদ্দিসের ঐকমত্যে জাল, বানোয়াট ও মিথ্যা।[৯]
বস্তুতঃ এ সালাতুর রাগাইবের সর্বপ্রথম প্রচলন ঘটে ৪৮০ হিজরীতে ফিলিস্তিনে। এর পূর্বে নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম), সাহাবীগণ, তাবিয়ীগণ এবং ৪৮১ হিজরীর পূর্বে কোন সালফে সালিহীন তা আদায় করেছেন বলে কোন সঠিক প্রমাণ নেই।[১০]
ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন : “সকল ইমামের ঐকমত্যে সালাতুর রাগাইব বিদ‘আত। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বা কোন খলীফা কেউই এটা চালু করেননি এবং ইমাম মালিক, শাফি‘য়ী, আহমাদ, আবূ হানীফাহ্, সাওরী, আওযাঈ, লাইস (রাহিমাহুল্লা-হ) প্রমুখ কেউই এটা পছন্দ করেননি। আর এ বিষয়ে যে হাদীস বর্ণনা করা হয় সকল মুহাদ্দিসের ঐকমত্যে তা মিথ্যা ও বানোয়াট।”[১১]
অতএব শবে মি‘রাজকে কেন্দ্র করে সালাতুর রাগাইবসহ সকল প্রকার বিশেষ সালাত বিদ‘আত- যা হারাম হিসেবে অবশ্যই বর্জনীয়।
২। বিশেষ রোযা পালন : শবে মি‘রাজকে কেন্দ্র করে রজব মাসের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত প্রতি বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও ২৬ তারিখে এভাবে বিভিন্ন দিনে রোযা রাখা সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত অনেক মিথ্যা ও জাল হাদীসের ছড়াছড়ি রয়েছে। দীর্ঘ হয়ে যাবে আশংকায় এখানে সে সব হাদীসের অবতারণা না করে এ প্রসঙ্গে মুহাদ্দিসীনে কিরামদের কিছু বক্তব্য উল্লেখ করাই যথেষ্ট মনে করি।
ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন : “রজব মাসের ফযীলত বর্ণনায় বা সে মাসে রোযার ফযীলত বর্ণনায় অথবা এ মাসে কোন নির্দিষ্ট দিনে রোযা রাখা বা রাত্রি জাগরণ সম্পর্কে বিশুদ্ধ কোন সহীহ হাদীস প্রমাণিত হয়নি।”[১২]
ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ্ (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন : “রজব মাসকে বিশেষভাবে সম্মান করা বিদ‘আতের অন্তর্ভুক্ত, আর এ মাসকে রোযার মৌসুম হিসাবে মনে করা ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লা-হ)-সহ সকলেই অপছন্দ করতেন।”[১৩]
সুতরাং রজব মাসে বিশেষ রোযা রাখার ব্যাপারে সব হাদীসই দুর্বল; বরং জাল বা বানোয়াট, যা কোন মুহাদ্দিসের নিকটই গ্রহণযোগ্য নয়। অতএব তা অবশ্যই বর্জনীয়।[১৪]
সাহাবীদের অনেকেই এ মাসে বিশেষ রোযা রাখলে বাধা দিতেন। এমনকি আমীরুল মু’মিনীন ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হু) যাদেরকে এ রোযা রাখতে দেখতেন তাদেরকে প্রহার করতেন এবং রোযা ভেঙ্গে ফেলার জন্য খেতে বাধ্য করতেন, আর বলতেন : রজব এমন মাস, যাকে জাহিলী যুগের লোকেরা সম্মান করত, বড় করে দেখাত। (অতএব তোমরা এরূপ করো না)।[১৫]
৩। শবে মি‘রাজের আনুষ্ঠানিকতা : ২৭শে রজবের রাত্রিকে তথাকথিত শবে মি‘রাজ বা মি‘রাজের রজনী বলা হয়। এজন্য যে সব আনুষ্ঠানিকতা, মাসজিদে আলোকসজ্জা ও খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়, যার বর্ণনা দিতে গেলে আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাবে, তাই সেসব অনর্থক কথাবার্তার অবতারণা না করে এ সম্পর্কে বিদ্বানদের কিছু বক্তব্য তুলে ধরতে চাই।
বিংশ শতাব্দীর বিশ্ববিখ্যাত ‘আলিমে দীন আল্লামা শাইখ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন : কোন মুসলিমের জন্য মি‘রাজের রজনীকে কেন্দ্র করে কোন প্রকার আনুষ্ঠানিকতায় লিপ্ত হওয়া বৈধ হবে না। কারণ নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও তাঁর সাহাবায়ে কিরাম (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হুম)-গণ মি‘রাজের রাতকে কেন্দ্র করে কোন প্রকার আনুষ্ঠানিকতা করেননি এবং বিশেষ কোন ‘ইবাদতেরও প্রচলন ঘটাননি। অতএব, এ আনুষ্ঠানিকতা যদি শরী‘আতসম্মত হত তাহলে অবশ্যই নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্বীয় উম্মাতকে তাঁর কথা বা কাজের মাধ্যমে অবগত করাতেন এবং সাহাবীগণও তা বর্ণনা করতেন। সুতরাং এটা এক ভ্রান্ত বিদ‘আত, যা হতে বিরত থাকা প্রতিটি মুসলিমের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য।[১৬]
এ হলো মি‘রাজের রাত্রির আনুষ্ঠানিকতার কথা, আর এ আনুষ্ঠানিকতার সাথে যা কিছু হয়ে থাকে তা বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশেষ করে এ দিনকে কেন্দ্র করেই মাযারসমূহে শুরু হয় গাজার আসর, শুরু হয় অবাধে নারী-পুরুষের যৌথভাবে গান-তামাসার আসর ইত্যাদি যা একজন জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি একটু চিন্তা করলেই বলবেন যে, এটা ইসলাম গর্হিত ও নিষিদ্ধ পাপ কর্ম ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সঠিক বুঝ দান করে এ সমস্ত ভ্রান্ত কাজ হতে বিরত থাকার তাওফীক দান করুন -আমীন।
ইস্রা ও মি‘রাজে করণীয় ও বর্জনীয় : ইস্রা ও মি‘রাজ ইসলামের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। এতএব মুসলিম উম্মাহর জন্য ইস্রা ও মি‘রাজকে কেন্দ্র করে অবশ্যই কিছু করণীয় ও শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। আবার ইস্রা ও মি‘রাজকে কেন্দ্র করে অনেক মাত্রাতিরিক্ততাও সমাজে চালু হয়েছে যা অবশ্যই বর্জনীয়। নিম্নে সংক্ষিপ্তভাবে ইসরা ও মি‘রাজে করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়সমূহ আলোকপাত করা হলো-
ইস্রা ও মি‘রাজের করণীয় ও শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ-
১। ইস্রা ও মি‘রাজের প্রতি ঈমান : ইস্রা ও মি‘রাজ ইসলামে একটি বাস্তব ও সত্য বিষয়। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে সূরা বানী ইসরা-ঈল-এর ১ম আয়াতে ইস্রা বা মাসজিদে হারাম হতে মাসজিদে আকসা পর্যন্ত রাত্রিবেলা ভ্রমণের বর্ণনা দিয়েছেন। আর সূরা আন্ নাজ্ম-এর ১৩ হতে ১৮ আয়াতে মি‘রাজ বা উর্ধ্বগমনের বিষয়টি বর্ণনা করেছেন। অপরপক্ষে সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমসহ অসংখ্য সহীহ হাদীসে ইস্রা ও মি‘রাজ সংক্রান্ত বর্ণনাসমূহ স্থান পেয়েছে।
অতএব ইসরা ও মি‘রাজ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কুরআন ও সহীহ হাদীসে যেরূপ বর্ণনা এসেছে অনুরূপ এর প্রতি ঈমান বা বিশ্বাস স্থাপন করা প্রতিটি মুসলিমের অপরিহার্য কর্তব্য। ইমাম তাহাবী (রাহিমাহুল্লা-হ) আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ‘আক্বীদাহ্ বিশ্বাস বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন :
“মি‘রাজ হক্ব বা সত্য বিষয়, আরো হক্ব কথা হলো যে, নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে স্বশরীরে ও জাগ্রতাবস্থায় রাত্রিবেলা ভ্রমণ ও উর্ধ্বে গমন করানো হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে উর্ধ্বজগতে নিয়েছেন, তাঁকে সম্মানিত করেছেন এবং তঁার প্রতি ওয়াহী করেছেন, আর তিনি যা দেখেছেন সত্যই বর্ণনা দিয়েছেন।”[১৭]
সুতরাং এ বিষয়ে প্রথম করণীয় হলো ইস্রা ও মি‘রাজের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।
২। মি‘রাজের রজনীতে অবতীর্ণ হওয়া ‘ইবাদাত পালনে সচেষ্ট হওয়া : আমরা অনেকেই জানি যে, মি‘রাজের রাত্রে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে সবচেয়ে বড় নির্দেশ হলো পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত। আমাদের নাবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মূসা (‘আলাইহিস্ সালাম)-এর পরামর্শে স্বীয় উম্মাতের প্রতি দয়াশীল হয়ে বারংবার মহান আল্লাহর কাছে আবেদন করলে পঞ্চাশের স্থলে পাঁচ ওয়াক্তে নেমে আসে। অবশ্য মহান আল্লাহর ঘোষণা হলো-
“যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত সম্পাদন করবে সে পঞ্চাশ ওয়াক্তের সওয়াব লাভ করবে।”[১৮]
এ হলো ফযীলতের বিষয় আর সতর্কতার বিষয় হলো রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন :
্রالفرق بين العبد وَالْكُفْرِ تَرْكُ الصَّلَاةِগ্ধ.
“একজন (মুসলিম) বান্দা ও কাফিরের মাঝে পার্থক্য হলো সালাত বর্জন করা।”[১৯]
এ হাদীসে সালাত বর্জনকারীকে কাফির বলা হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মি‘রাজকে কেন্দ্র করে সমাজে দুর্বল ও বানোয়াট প্রমাণের আলোকে রাত্রি জাগরণ, বিশেষ সালাত ও মিলাদ মাহফিল ইত্যাদির অপচর্চা শুরু হয়েছে। অথচ মি‘রাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, যা ব্যতীত কেউ পূর্ণ মু’মিন হতে পারে না- সেদিকে ঐ শ্রেণীর লোকের কোন গুরুত্ব নেই।
অতএব মি‘রাজের অন্যতম শিক্ষা হলো- মি‘রাজ আমাদের পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যা পালন করা অপরিহার্য কর্তব্য।
৩। আল্লাহ তা‘আলার স্ব-সত্তায় উর্ধ্বে অবস্থান : আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ‘আক্বীদাহ্ বিশ্বাস বর্ণনাকারীর অন্যতম ইমাম- ইমাম ইবনু আবিল ইয্য আল-হানাফী (রাহিমাহুল্লা-হ) মি‘রাজ সংক্রান্ত আলোচনার শেষে বলেন,
“যে ব্যক্তি মি‘রাজের বিষয়ে চিন্তা করবে সে এতে একাধিক দলীল প্রমাণ পেয়ে যাবে যে, আল্লাহ তা‘আলার অবস্থান উর্ধ্বে।”[২০]
সমাজে প্রচলিত “আল্লাহ তা‘আলা স্ব-সত্তায় সর্বত্র বিরাজমান” এরূপ বাতিল বিশ্বাস যা কুরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থী, মি‘রাজের ঘটনাও প্রমাণ করে যে এটা বাতিল বিশ্বাস; বরং আল্লাহ তা‘আলা স্বসত্তায় উর্ধ্বে রয়েছেন, এটাই প্রমাণ করে মি‘রাজের বাস্তব ঘটনা।
কারণ নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মি‘রাজেই আল্লাহ তা‘আলার অতি নিকটে যাওয়ার সুযোগ পান এবং এ সুযোগ পৃথিবীর কোথাও ঘটেনি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্থান কা‘বাতেও আল্লাহর নিকটে যাওয়ার সুযোগ হয়নি, পূর্বেও নয়, পশ্চিমেও নয়, উত্তরেও নয়, দক্ষিণেও নয়- এমনকি নাবী-রাসূলদের মিলনকেন্দ্র বাইতুল মাকদাসেও নয়। তথা তামাম পৃথিবীর কোথাও নয়; বরং মহান আল্লাহর স্ব-সত্তায় অবস্থান হলো সপ্ত আসমানের উর্ধ্বে আরশে আযীমের উপরে। মূলতঃ এ পরিচয় আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে বিশেষ করে সাতটি আয়াতে পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, তিনি আরশের উপর সমুন্নত। যেমন-
﴿الرَّحْمٰنُ عَلٰى الْعَرْشِ اسْتَوَى﴾
“দয়াময় (আল্লাহ) ‘আরশের উপর সমুন্নত।”[২১]
অতএব মি‘রাজ আমাদেরকে স্ব-সত্তায় মহান আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে সঠিক ‘আক্বীদাহ্ বিশ্বাস শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহ তা‘আলা স্ব-সত্তায় সর্বত্র বিরাজমান নন; বরং তিনি স্ব-সত্তায় ‘আরশের উপরে রয়েছেন। এটাই হলো সঠিক ‘আক্বীদাহ্ বিশ্বাস। এটাই হলো কুরআন ও সহীহ হাদীসের বিশুদ্ধ বর্ণনা। “আল্লাহ স্ব-সত্তায় সর্বত্র বিরাজমান”। এরূপ বিশ্বাসকারীকে ইমাম আবূ হানীফাহ্ (রাহিমাহুল্লা-হ) কাফির বলে আখ্যায়িত করেছেন।[২২]
অতএব মি‘রাজ সকল বাতিল বিশ্বাসকে নাকচ করে সত্য ও সঠিক বিশ্বাসের বাস্তব শিক্ষাই আমাদের দিয়ে যায়।
৪। বক্তা ও আলোচকদের করুণ পরিণতি : প্রসিদ্ধ সাহাবী আনাস (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন : আমি মি‘রাজের রজনীতে দেখলাম, আগুনের কেচি দিয়ে কিছু মানুষের ওষ্ঠদ্বয় কেটে নেয়া হচ্ছে (এ ‘আযাবের জ্বালা-যন্ত্রণায় তারা অস্থির)। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরীল! এরা কারা? তাদের এ করূণ অবস্থা কেন? জিবরীল বললেন : এরা হলো আপনার উম্মাতের বক্তা ও আলোচকবৃন্দ, যারা মানুষকে কল্যাণের আদেশ করত কিন্তু নিজেদের বিষয়টি ভুলে যেত, অথচ তারা কুরআন পড়ে, আসলে তারা কি কিছু উপলব্ধি করত না?[২৩]
অনেক বক্তা ও আলোচক আছেন, যারা আলোচ্য বিষয় নানা ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেন, যাতে শ্রোতা ভালভাবে বুঝে বাস্তবে তা পালন করতে পারে। পক্ষান্তরে আলোচক বা বক্তা মানুষকে পালন করার উপদেশ দিলেও নিজে উদাসীন, পালন করে না- এমন ব্যক্তিদের জন্যই ভয়াবহ শাস্তি রয়েছে। মি‘রাজের বিষয় হতে আমাদের এ শিক্ষা গ্রহণ করে সতর্ক হওয়া উচিত।
৫। পরনিন্দাকারী ও ব্যভিচারীদের শাস্তিভোগ : রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মি‘রাজের রাত্রিতে আরো যেসব ব্যক্তির শাস্তিভোগ ও করুণ পরিণতি দেখেন, তন্মধ্যে হলো গীবত বা পরনিন্দাকারীদের করুণ শাস্তি। তিনি (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দেখলেন, একদল মানুষ যাদের হাতের নখগুলো তামার এবং বিশাল আকৃতির ও খুব ধারাল, তারা ধারাল নখ দিয়ে নিজের চেহারা এবং বক্ষ হতে গোশ্ত খামচিয়ে ছিড়ছে। নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জিবরীলকে জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা এবং কেন তাদের এ কঠিন শাস্তি? জবাবে জিবরীল বললেন : তারা হলো ঐসব মানুষ যারা অন্যের গোশত ভক্ষণ করত এবং মানহানিকর কর্মে লিপ্ত হত। অর্থাৎ- তারা গীবত-পরনিন্দা ও পর সমালোচনায় মগ্ন থাকত, এজন্য তাদের এ করুণ শাস্তি।[২৪]
অনুরূপ নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ব্যভিচারী নর-নারীদের করুণ শাস্তির দৃশ্যও স্বচক্ষে দেখে বর্ণনা করেছেন।
মি‘রাজের বাস্তব চিত্র হতে এসব শিক্ষা গ্রহণ করে ঈমান ও আদর্শকে আরো সুদৃঢ় করা উচিত।
ইস্রা ও মি‘রাজে বর্জনীয় বিষয়সমূহ-
১। দিন তারিখ নির্দিষ্ট করা : ইস্রা ও মি‘রাজ নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জীবনে বাস্তব সংঘটিত হয়েছে, এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই, কিন্তু কোন সনে বা মাসে অথবা তারিখে সংঘটিত হয়েছে তার কোন বিশুদ্ধ দলীল-প্রমাণ না থাকায় দিন তারিখ নির্দিষ্ট করা বৈধ হবে না।
২। ইস্রা ও মি‘রাজে বিশেষ ‘ইবাদাত করা : ইস্রা ও মি‘রাজ সংগঠিত হওয়ার নির্দিষ্ট দিন-তারিখ কোন বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত হয়নি এবং সে উপলক্ষে কোন বিশেষ ‘ইবাদত, সালাত, সিয়াম, তাসবীহ ও তিলাওয়াত ইত্যাদি পালনেরও কোন সহীহ দলীল নেই। এতদসত্ত্বেও আবেগবশতঃ কোন ‘ইবাদতে লিপ্ত হলে সাওয়াবের পরিবর্তে গুননাহগার হতে হবে। কারণ মি‘রাজ রজনীকে কেন্দ্র করে নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও সাহাবী (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হুম)-গণ বিশেষ কোন ‘ইবাদত করেননি এবং করার অনুমতিও দেননি। অতএব শবে মি‘রাজের তথাকথিত বিশেষ ‘ইবাদত শরী‘আতসম্মত নয়; বরং এটি একটি ভ্রান্ত ‘ইবাদত যা মানুষকে গুমরাহ ও জাহান্নামের দিকেই নিয়ে যাবে। সুতরাং সমাজের প্রচলিত প্রথা বর্জন করা একান্ত প্রয়োজন।
৩। জাহিলী যুগের প্রথার অনুসরণ ও পুনঃপ্রচলন : রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও সাহাবীদের মাঝে রজব মাসে মি‘রাজকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোন সালাত, সিয়াম ও কুরবানী ছিল না। কিন্তু তাঁর পূর্বে জাহিলী যুগে রজব মাসকে খুবই গুরুত্ব প্রদান করা হত। এ মাসে বিশেষ ‘ইবাদত নযর-নেয়াজ ও কুরবানী করা হত। সাহাবীদের যুগে যাতে জাহিলী অপচর্চা পুনঃপ্রচলন না হয় সে জন্য তাঁরা খুব কঠোর ছিলেন। যেমন- ‘আমীরুল মু’মিনীন ‘উমার ইবনু খাত্তাব (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হু)-এর যুগে যারা রজব মাসে বিশেষ সিয়াম পালন করত, তিনি তাদের গ্রেফতার করে প্রহার করতেন এবং সওম ভেঙ্গে ফেলার জন্য বাধ্য করে খাওয়াতেন, আর বলতেন : রজব এমন মাস যাকে জাহিলী যুগের লোকেরা সম্মান করত এবং গুরুত্ব দিত।[২৫]
অতএব জাহিলী যুগে এ মাসের বিশেষ গুরুত্ব ও বিশেষ ‘ইবাদত ছিল, অতঃপর নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও সাহাবীদের যুগে তা ছিল না; বরং জাহিলী প্রথার প্রতিবাদ ছিল। সাহাবীদের স্বর্ণযুগের পর আবার কুরআন-সুন্নাহর অজ্ঞতা বেড়ে যাওয়ায় প্রবৃত্তির তাড়নায় ও শয়ত্বানী প্ররোচনায় বর্তমান যুগের নামধারী কিছু মুসলিম সেই জাহিলী প্রথার অনুসরণ করে রজব মাসে বিশেষ ‘ইবাদাত প্রচলন করেছে। আল্লাহ ভীরু প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তির কুরআন ও সহীহ হাদীস বিরোধী এ জাহিলী ‘ইবাদত অবশ্যই বর্জন করা উচিত। আল্লাহ তা‘আলা তাওফীক্ব দান করুন -আমীন।

[১] শারহু ‘আক্বীদাহ্ আত-তাহাবীয়্যাহ- ২২৩।
[২] ফাতহুল বারী- ১/৫৯৬ পৃঃ।
[৩] সূরা বানী ইসরা-ঈল ১৭ : ১।
[৪] সূরা আন্ নাজ্ম ৫৩ : ১৩-১৮।
[৫]  দ্রঃ আল আ’ইয়াদ- ৩৫৯-৩৬০ পৃঃ, আর রাহীকুল মাখতুম- ১৩৭ পৃঃ, আল বিদা আল হাওলিয়া- ২৭০-২৭৪।
[৬] আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া- ৩/১০৭ পৃঃ।
[৭] আল বায়েস ফী ইনকারিল বিদা- ৭১ পৃঃ।
[৮] যাদুল মা‘আদ- ১/৫৭ পৃঃ।
[৯] দ্রঃ কিতাবুল মাওযুয়াত- ২/১২৪, ১২৫ পৃঃ।
[১০] দ্রঃ আল হাওয়াদিস ওয়াল বিদা- ১২২ পৃঃ।
[১১] মাজমু‘ ফাতাওয়া- ২৩/১৩৪ পৃঃ।
[১২] আল-বিদা আল-হাওলিয়া- ২১৪ পৃঃ।
[১৩] ইকতিযাউস সিরাত- ২/৬২৪, ৬২৫।
[১৪] আল-বিদা আল-হাওলিয়া- ২২৬ পৃঃ।
[১৫] আল-বিদা আল-হাওলিয়া- ২৩৪ পৃঃ।
[১৬] দ্রঃ আল-বিদা ওয়াল মুহদাসাত- ৫৮৯-৫৯০ পৃঃ।
[১৭] শারহুল ‘আক্বীদাহ্ আত্ তাহাবীয়্যাহ- ২২৩ পৃঃ।
[১৮] সহীহুল বুখারী- হাঃ ৩৪৯।
[১৯] সহীহ মুসলিম- হাঃ ১৩৪/৮২, মিশকা-তুল মাসা-বীহ- ৪৮ পৃঃ।
[২০] শারহুল ‘আক্বীদাহ্ আত্ তাহাবীয়্যাহ্- ২২৬ পৃঃ।
[২১] সূরা ত্ব-হা- ২০ : ৫।
[২২] মুখতাসার আল উলু- ১৩৬ পৃঃ।
[২৩] মুসনাদে আহমাদ- হাসান।
[২৪] মুসনাদে আহমাদ- সহীহ।
[২৫] আল বি‘দা আল হাওলিয়াহ- ২৩৪ পৃঃ।

আপনার মন্তব্য

ঢাকায় সূর্যোদয় : 5:43:02 সূর্যাস্ত : 6:09:54

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত