عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيْرٍ، أَنَّهُ قَالَ : إِنَّ أَبَاهُ أَتَىْ بِهِ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ، فَقَالَ : إِنِّيْ نَحَلْتُ ابْنِيْ هَذَا غُلَامًا كَانَ لِيْ، فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ : ্রأَكُلَّ وَلَدِكَ نَحَلْتَهُ مِثْلَ هَذَا؟গ্ধ فَقَالَ : لَا، فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ : ্রفَارْجِعْهُগ্ধ.
সরল অনুবাদ : নু‘মান ইবনু বাশীর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন যে, তার পিতা তাকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে বললেন, আমার এই পুত্রকে আমি আমার একটি গোলাম (কৃতদাস) দান করেছি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে বললেন, তুমি কি তোমার সকল সন্তানকে এরূপ দান করেছ? তিনি বললেন, না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, তাহলে তুমি ফেরত নাও।[১]
হাদীসটির উৎস : উল্লিখিত হাদীসটি সহীহুল বুখারী; সুনান আবূ দাঊদ, সুনান আন্ নাসাঈ, মুসনাদ আহমাদ এবং মু‘আত্তা ইমাম মুহাম্মদ (সাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে।
রাবীর পরিচয় : বাশীর ইবনু সা‘দ (রাযিঃ) খাযরাজ গোত্রীয় আনসার সাহাবী ছিলেন। তিনি বদর উহুদসহ পরবর্তী যুদ্ধসমূহে অংশগ্রহণ করেন। তিনিই সর্বপ্রথম আবূ বক্বর সিদ্দিক (রাযিঃ)-এর হাতে খিলাফতের বাইয়াত গ্রহণ করেন। তাঁর পুত্র নু‘মান (রাযিঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ইন্তিকালের ছয় বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন। তবে কোনো কোনো মুহাম্মদ এ কথা বলেছেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে সরাসরি হাদীস শুনেছেন এ কথা সঠিক নয়। আমীর মু‘আবিয়াহ্ (রাযিঃ) তাকে প্রথমে হিমস অতঃপর কুফার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। ইয়াযীদের মৃত্যুর পর তিনি সিরিয়াবাসীদেরকে ‘আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়িরের খিলাফত স্বীকার করে নেয়ার আহ্বান জানান। এতে হিমসবাসীরা ৬৪ হিজরী সনে তাঁকে হত্যা করে। (উসুদুল গাবা) তার পুত্র মুহাম্মদ আবূ সা‘ঈদ সিকাহ তাবি‘ঈ ছিলেন (তাহাযিবুত তাহযীব)।[২]
ব্যাখ্যা : হাদীসটিকে ইমাম মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর মু’আত্তায় ব্যবসায়-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় অধ্যায়ে স্থান দিয়েছেন। পারিবারিক জীবনে ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় হাদীসটির দিক-নির্দেশনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণতঃ পিতা-মাতার মৃত্যুর পর সন্তানগণ তাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির সুনির্দিষ্ট অংশ লাভ এবং তা ভোগ করে থাকেন, এ বিষয়ে কুরআন সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রদান করেছে। কিন্তু পিতা-মাতার জীবিত থাকাকালেও যে, সন্তান-সন্তুতি স্বীয় পিতা-মাতার কাছ থেকে ইনসাফ ভিত্তিক অধিকার বা কিছু প্রাপ্তির অধিকারী তার বর্ণনাই এসেছে হাদীসটিতে। পাশাপাশি এ বিষয়টিও স্পষ্ট করা হয়ে যে, সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে সমতা ঠিক রাখতে হবে যেন পক্ষপাতমূলক কিছু না ঘটে।
স্নেহের আতিশয্যে কোনো এক সন্তানের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করা মা-বাবার জন্য কাম্য নয়। এ হাদীসটিতে পারিবারিক শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার তাকিদ করা হয়েছে। বিশেষ করে দান ও উপঢৌকনের ক্ষেত্রে এক পুত্র দুই কন্যার সমান অংশ পাবে। এ বিধান অনুসরণ করতে হবে বলে ইমাম মুহাম্মদ ইবনু হাসান মত প্রকাশ করলেও ইমাম সুফ্ইয়ান, আহমাদ, ইমাম বুখারীর মতে দান ও উপঢৌকনের ব্যাপারে সন্তানদের মধ্যে সমতা বিধান করা ওয়াজিব।
সন্তান-সন্তুতির প্রতি ইনসাফপূর্ণ আচরণ ও তাদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন মহান আল্লাহর কাছে বান্দার একটি উত্তম ‘আমল বলে গণ্য।
আল্লাহ তা‘আলা যেমন তাঁর সৃষ্ট জগতের প্রতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমানভাবে করুণাবর্ষণ করেন, তেমনি মা-বাবারও উচিত সমানভাবে সন্তান-সন্তুতির প্রতি স্নেহ, দয়া-মায়া প্রদর্শন করা।
অবশ্য যদি কোনো সন্তান বিশেষ অসুবিধায় পড়ে বা রোগাক্রান্ত হয় অথবা কন্যা বিধবা হয়ে যায়, এ রকম বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অবস্থা অনুসারে পিতা-মাতার উচিত তাদের প্রতি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই বিশেষ অবস্থায় কোনো সন্তানদের জন্য অধিক খরচ করা দান-উপঢৌকন প্রদানের মতো সমতার বিধানে আসবে না।
পিতার প্রতি সন্তানের স্বাভাবিকভাবেই অধিকার রয়েছে। কিন্তু যখন কোনো সন্তান অসহায় বা নিরুপায় হয়ে পড়ে তখন তার প্রতি পিতার দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়। যখন কোনো কন্যা সন্তান বিধবা হয়ে পড়ে অথবা তার কোনো অবলম্বন থাকে না। তখন পিতার অতিরিক্ত দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, তার সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসা।
আমাদের বর্তমান সমাজেও অনেক বাবা-মা মেয়েদের তুলানায় ছেলেদেরকে অধিক গুরুত্ব দেন, এমনকি কন্যাসন্তানদেরকে সম্পত্তি থেকেও মাহরুম করেন, যা শরী‘আতের দৃষ্টিতেও অন্যায় ও পাপের কাজ বলে গণ্য। যে কারণে অনেক পরিবারেই দ্বন্দ্ব কলহ লেগে থাকে। তাই পরিবারে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সকলের এ হাদীসের প্রতি ‘আমল করা প্রয়োজন। কোনো বাবা-মা কোনো এক সন্তানকে দান-উপঢৌকন নয়; বরং বিশেষ প্রয়োজনে তার জন্য বেশি সম্পদ ব্যয় করেন বা মায়া-মমতা প্রদর্শন করেন (যেমন- প্রতিবন্দ্বী সন্তান) তবে সেই সন্তানের অন্য ভাইবোনের উচিত হবে না তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হওয়া; বরং তাদেরও উচিত অসুবিধায় পতিত সেই ভাই-বোনদের প্রতি অধিকতর দরদী হওয়া এবং এ কাজ তাদের জন্য উত্তম মর্যাদার কারণ হবে -ইন্শা-আল্লাহ।
দুনিয়ার জীবনে সন্তান-সন্তুতি আনন্দ ও চাকচিক্যের বস্তু। এ মর্মে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেন :
﴿الْمَالُ وَالْبَنُوْنَ زِيْنَةُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا﴾
“ধন-মাল ও সন্তান-সন্তুতি শুধু দুনিয়ার জীবনের চাকচিক্য মাত্র।”[৩]
এই চাকচিক্যে ভুলে গিয়ে মানুষ পাপে ডুবে যায়। আমরা যেন এই সন্তানদের মাঝে বৈষম্য সৃষ্টি করে পাপ কামাই না করি তার জন্য সাবধান ও সতর্ক হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
দুর্বল কমজোর সন্তানদের জন্য ব্যয় করা অতি পুণ্যের কাজ। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন :
্রفَأَيُّ رَجُلٍ أَعْظَمُ أَجْرًا مِنْ رَجُلٍ يُنْفِقُ عَلٰى عِيَالٍ لَهُ صِغَارٍগ্ধ.
সেই ব্যক্তির চেয়ে পুণ্য ও পুরষ্কার লাভের যোগ্যতর কে হতে পারে, যে নিজের কমজোর সন্তান-সন্তুতির জন্য ব্যয় করে।[৪]
সর্বোপরি হাদীসটির মূল শিক্ষা হলো এই যে, পিতা-মাতার উপর সন্তানদের এ অধিকার রয়েছে যে, লেনদেনে তার সন্তানদের মধ্যে ইনসাফ ও সমতা বিধান করবে।
হাদীসের শিক্ষা :
প্রথমতঃ কোনো পিতা-মাতার জন্য এটা উচিত নয় যে, তিনি তার কোনো এক সন্তানকে অধিক ভালোবাসবেন এবং অন্যদের প্রতি অবহেলা করবেন। কেননা, এর ফলে সন্তানদের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়, যার পরিণাম অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভয়াবহ।
দ্বিতীয়তঃ বিপদগ্রস্ত, রোগগ্রস্ত, প্রতিবন্ধী, বিধবা প্রভৃতি সন্তানের প্রতি পিতা-মাতা অধিক স্নেহপরায়ণ হলে কিংবা অতিরিক্ত ব্যয় করলে তার অন্য ভাইবোনদেরও উচিত নয় যে, তারা হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করবে।
তৃতীয়তঃ পবিরারে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সর্বদা সতর্কতা অবলম্বন করা। ভাইবোনদের মাঝে মানোমালিন্য সৃষ্টি হতে পারে এমন আশঙ্কায় পিতা-মাতার উচিত তাদের সাথে কথা বলা এবং প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা প্রদান করা।
উপসংহারে বলা যায় যে, সন্তান-সন্তুতির মাঝে ভেদাভেদ সৃষ্টি করা বৈধ নয়; বরং সকল সন্তানের প্রতি সমতা বজায় রাখা একান্ত জরুরী। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন -আমীন। #
[১] সহীহ মুসলিম- হা. ৯/১৬২৩।
[২] উদ্ধৃত- মু‘আত্তা ইমাম মুহাম্মদ মূসা-এর টীকা, পৃঃ ৫১১।
[৩] সূরা আল কাহ্ফ ১৮ : ৪৬।
[৪] সুনান আত্ তিরমিযী- মাঃ শাঃ, হাঃ ১৯৬৬, সহীহ।
আপনার মন্তব্য1