﴿قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ هُمْ فِيْ صَلَاتِهِمْ خَاشِعُوْنَ وَالَّذِيْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُوْنَ وَالَّذِيْنَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُوْنَ وَالَّذِيْنَ هُمْ لِفُرُوْجِهِمْ حَافِظُوْنَ إِلَّا عَلٰى أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِيْنَ فَمَنِ ابْتَغَى وَرَاءَ ذٰلِكَ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْعَادُوْنَ وَالَّذِيْنَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُوْنَ وَالَّذِيْنَ هُمْ عَلٰى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُوْنَ أُوْلَئِكَ هُمُ الْوَارِثُوْنَ الَّذِيْنَ يَرِثُوْنَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيْهَا خَالِدُوْنَ﴾
সরল অনুবাদ : “নিশ্চিতভাবেই সফলকাম হয়েছে মু’মিনগণ। যারা নিজেদের সালাতে বিনয়ী ও ন¤্র। যারা বাজে বা বেহুদা কথা কাজ থেকে দূরে থাকে। যারা তাযকিয়া বা পরিশুদ্ধির ব্যাপারে কর্মতৎপর হয়। আর যারা নিজেদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে। তবে তাদের স্ত্রীদের ও মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে না রাখলে তারা তিরস্কৃত হবে না। তবে যদি কেউ তাদের ছাড়া অন্য কাউকে যৌন ক্ষুধা মেটাবার জন্য কামনা করে তবে তারা হবে সীমালঙ্ঘনকারী। আর যারা তাদের আমানতসমূহ এবং ওয়াদাচুক্তির (অঙ্গীকার) রক্ষণাবেক্ষন করে। আর যারা তাদের সালাতসমূহ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে। তারাই উত্তরাধিকার লাভ করবে, তারা উত্তরাধিকার হিসেবে ফিরদাউস পাবে এবং সেখানে চিরদিন থাকবে।”
নামকরণ : সূরার নামকরণ দু’ভাবে হয়ে থাকেÑ
বহুল আলোচিত শব্দ অর্থাৎ- শব্দভিত্তিক যেমন- নাস, ফালাক্ব।
বিষয়ভিত্তিক : যেমন- সূরা ফাতিহা ও আল ইখলা-স।
এ সূরাটি ১ম আয়াতের আল মু’মিনূন শব্দ থেকে নামকরণ করা হয়েছে।
নাযিল হওয়ার সময়কাল ও মূল বিষয়বস্তু : সূরাটি মাক্কী, হিজরতের পূর্বে নাযিল হয়েছে। তবে ঠিক কোন্ সময়ে নাযিল হয়েছে তা সঠিকভাবে বলা যায় না। বর্ণনাভঙ্গি ও বিষয়বস্তু হতে প্রতীয়মান হয় যে, এ সূরা রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মাক্কী জীবনের মাঝামাঝি সময়ে নাযিল হয়েছিল।
এ সূরার মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে রাসূলের আনুগত্য করার আহ্বান। সূরার প্রথমে এ আলোচনা করা হয়েছে যে, নাবীর অনুসারী মু’মিনগণের কতিপয় গুণাবলী রয়েছে, এই বিশেষ গুণাবলী অর্জনকারীরাই সফলকাম। ইহকালে ও পরকালে তারাই সাফল্য লাভ করবে। পরে এ সূরায় মানব সৃষ্টির বিভিন্ন স্তরের কথা আলোচনা করা হয়েছে এবং স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, যিনি সৃষ্টি করতে সক্ষম তিনি তোমাদেরকে পরকালে তার সামনে হাযির করতেও সক্ষম। তিনি তোমাদের হিসাব-কিতাব নিবেন। তেমনিভাবে বিভিন্ন উম্মাতের কথা উল্লেখ করে তাদের পরিণতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে যেন দুনিয়াবাসী নাবী কারীম (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আনুগত্য করে, মহান আল্লাহর বিধানকে মেনে নেয়, তাঁরই ‘ইবাদত করে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য না করলে কেউ মুক্তি পাবে না এসব বিষয়গুলোই এ সূরায় আলোচনা করা হয়েছে।
সূরা আল মু’মিনূনের ফযীলত : ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রতি যখন ওয়াহী নাযিল হত তখন মৌমাছির গুঞ্জনের ন্যায় আওয়াজ শুনা যেত। একদিন তাঁর কাছে এমনি আওয়াজ শুনে আমরা ওয়াহী শুনার জন্য থেমে গেলাম। ওয়াহীর বিশেষ এ অবস্থার শেষ হলে নাবী কারীম (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ক্বিবলামুখী হয়ে বসে পড়লেন এবং দু‘আ করতে লাগলেন :
اَللّٰهُمَّ زِدْنَا وَلَا تَنْقُصْنَا وَأَكْرِمْنَا وَلَا تُهِنَّا وَأَعْطِنَا وَلَا تَحْرِمْنَا وَآثِرْنَا وَلَا تُؤْثِرْ عَلَيْنَا وَاَرْضِنَا وَارْضَ عَنَّا.
“হে আল্লাহ! আমাদেরকে বেশী দাও কম দিয়ো না। আমাদের সম্মান বৃদ্ধি করোÑ লাঞ্ছিত করো না। আমাদেরকে দান করোÑ বঞ্চিত করো না। আমাদেরকে অন্যের উপর অধিকার দাও অন্যদেরকে আমাদের উপর অগ্রাধিকার দিয়ো না, আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাক এবং আমাদেরকে তোমার প্রতি সন্তুষ্ট করো।”
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন : এক্ষণে দশটি আয়াত নাযিল হয়েছে। কেউ যদি এ আয়াতগুলো পুরোপুরি পালন করে, তবে সে সোজা জান্নাতে যাবে। এরপর তিনি সূরা মু’মিনূনের প্রথম দশটি আয়াত পাঠ করে শুনালেন।
ইমাম আন্ নাসায়ী তাফসীর অধ্যায়ে ইয়াযীদ ইবনু কাবনুস (রাহিমাহুল্লা-হ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ‘আয়িশাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা)-কে প্রশ্ন করা হয় যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর চরিত্র কিরূপ ছিল? তিনি বললেন, তার চরিত্র কুরআনে বর্ণিত আছে, অতঃপর তিনি এই দশটি আয়াত তিলাওয়াত করে বললেন : এগুলোই ছিল রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর চরিত্র ও অভ্যাস।
শানে নুযূল : অত্র সূরা বিশেষ করে তিলাওয়াতকৃত আয়াতগুলো নাযিলের সময় মক্কার কাফিররা যেমন ছিল ইসলামের চরম বিরোধী তেমনি পার্থিব উপকরণ সব ছিল তাদের হাতের মুঠোয়। অপরদিকে মুসলমানদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। অর্থাৎ- আর্থিক ও সামাজিক অবস্থানগত দিক থেকে তারা ছিল শোচনীয় পর্যায়ে।
এই অবস্থায় কাফিররা নিজেদের অধিক সফল এবং মুসলমানদের ব্যর্থ মনে করত। তখন মু’মিনদের প্রকৃত সফলতার ঘোষণা দিয়ে এ আয়াতগুলো নাযিল করেন।
আয়াতসমূহের সংক্ষিপ্ত তাফসীর : ‘নিশ্চিতভাবে সফলকাম হয়েছে মু’মিনগণ।’
এখানে মু’মিন বলতে তারা যারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উপর ঈমান এনে তার আনীত বিধান মেনে নিয়েছে এবং তার দেখানো জীবনপদ্ধতি অনুসরণ করেছে।
“নিশ্চিতভাবেই সফলতা লাভ।” দিয়ে বাক্য শুরু করার তাৎপর্য বুঝতে হলে নাযিলের পরিবেশকে সম্মুখে রাখা দরকার।
তৎকালীন সময়ে কাফিরদের ইসলাম বিরোধিতা; তাদের সামাজিক ও আর্থিক উন্নতি ও মুসলমানদের সামাজিক এবং আর্থিক পশ্চাতপদতা।
আল্লাহ তা‘আলা যখন এই মুসলমানদেরই সফল বললেন তখন বুঝা যায় মহান আল্লাহর নিকট সফলতার মানদ- ঈমান, দুনিয়ার অর্থ বৈভব নয়। প্রকৃত সাফল্য আখিরাত।
প্রকৃত সাফল্য : যে নিজেকে পাপ থেকে পবিত্র রেখেছে সেই সফল।
সফলতা লাভের জায়গা আখিরাত। যেমন- আল্লাহ বলেন :
﴿بَلْ تُؤْثِرُوْنَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا. وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ وَأَبْقَى﴾
অর্থাৎ- “(হে মানুষ!) তোমরা দুনিয়াকেই পরকালের উপর অগ্রাধিকার দিচ্ছ। অথচ দুনিয়ার তুলনায় আখিরাতের জীবন অতি উত্তম এবং স্থায়ী।”
আলোচ্য আয়াতসমূহে আল্লাহ তা‘আলা সেসব মু’মিনকে সাফল্য দান করার ওয়া‘দা করেছেন। যারা আয়াতে উল্লিখিত সাতটি গুণে গুণান্বিত। পরকালের পূর্ণাঙ্গ সাফল্য এবং দুনিয়ার সম্ভাব্য সাফল্য সবই এই ওয়াদার অন্তর্ভুক্ত।
মু’মিনদের সাতটি গুণ : সর্বপ্রথম গুণ হলো ঈমানদার হওয়া। কিন্তু এটা একটা বুনিয়াদী ও মৌলিক বিষয় বিধায় এটাকে এই সাতটি গুণের মধ্যে শামিল না করে পর পর সাতটি গুণ বর্ণনা করা হয়েছে।
প্রথম গুণ : অর্থ্যাৎ- “যারা তাদের সালাতে বিনয়ী ও ন¤্র।”
﴿الَّذِيْنَ هُمْ فِيْ صَلَاتِهِمْ خَاشِعُوْنَ﴾
সালাতে খুশু বলতে বিনয় ও ন¤্র হওয়া বুঝায়। খুশুর আভিধানিক অর্থ স্থিরতা। শরী‘আতের পরিভাষায় এর মানে অন্তরে স্থিরতা থাকা। অর্থাৎ- আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কোন কিছুর কল্পনা অন্তরে ইচ্ছাকৃতভাবে না করা এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গ স্থির রাখা।
দিলের খুশু হয় তখন যখন কারো ভয়ে বা দাপটে অন্তর ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। আর দেহের খুশু এভাবে প্রকাশ পায় যে, কারো সামনে গেলে তার মাথা নিচু হয়ে যায়। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্থির হয়ে পড়ে, চোখের দৃষ্টি নত হয়ে আসে, গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে যায়।
আবূ যার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনÑ সালাতের সময় আল্লাহ তা‘আলা বান্দার প্রতি সর্বক্ষণ দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখেন যতক্ষণ না সালাত আদায়কারী অন্যদিকে ভ্রুক্ষেপ করে। যখন সে অন্যকোন দিকে ভ্রুক্ষেপ করে তখন আল্লাহ তা‘আলা তার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন।
শরী‘আতে বর্ণিত সালাতের নিয়ম নীতি সালাতে খুশু পয়দা করতে সাহায্য করে।
সালাতে খুশু সৃষ্টির জন্য যা করতে হবে :
১. আল্লাহ তা‘আলা আমাকে সর্বক্ষণ দেখছেন Ñএমন মনে করা। হাদীসে জীবরীলে ইহসান সম্পর্কে মহানাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রশ্ন করলে তার প্রতিউত্তরে তিনি বলেন,
أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ ، فَإِنَّهُ يَرَاكَ.
“তুমি এভাবে মহান আল্লাহর ‘ইবাদত করবে (সালাতে) যেন তুমি মহান আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছ। আর যদি তোমার পক্ষে এটা সম্ভব না হয়। তবে তুমি অবশ্যই মনে করে নেবে যে আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে দেখছেন।”
২. সালাতে পঠিত দু‘আ, কালাম অন্তর থেকে পড়া।
৩. সালাতে খুশু সৃষ্টি করার জন্য সালাত আদায়কারীর দৃষ্টি সাজদার দিকে থাকবে।
৪. সালাতে একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য সালাতে যা পড়া হয় তার অর্থ জানা।
দ্বিতীয় গুণ : ‘যারা বেহুদা কাজ ও কথা থেকে দূরে থাকে।’
﴿وَالَّذِيْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُوْنَ﴾
اَللَّغْوُ বলা হয় এমন প্রতিটি কাজ এবং কথাকে যা অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন ও নিস্ফল। যেসব কথা এবং কাজের কোনই ফল নেই।
اَللَّغْوُ-এর অর্থ উচ্চস্তরের গুনাহ যাতে ধর্মীয় উপকার তো নেই-ই বরং ক্ষতি বিদ্যমান। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন :
مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُه مَالَا يَعْنِيْهِ.
“মুসলিম ব্যক্তির ইসলামিক সৌন্দর্যের একটি দিক হলোÑ অনর্থক বিষয়াদি পরিত্যাগ করা।”
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :
﴿وَإِذَا مَرُّوْا بِاللَّغْوِ مَرُّوْا كِرَامًا﴾
“যখন এমন কোন জায়গা দিয়ে তারা চলে যেখানে বাজে কথা হতে থাকে অথবা বাজে কাজের মহড়া চলে তখন তারা ভদ্রভাবে সে জায়গা অতিক্রম করে চলে যায়।”
মু’মিনের মাঝে সবসময় দায়িত্বানুভুতি জাগ্রত থাকে।
তার কাছে দুনিয়াটা পরীক্ষাগার। পরীক্ষার হলে নির্দিষ্ট সময়ে সবকিছু করতে হয়। ফুটবল, ক্রিকেট খেলা দেখায় পার্থিব বা আখিরাতের কোন কল্যাণ নেই।
তৃতীয় গুণ : যারা যাকাত বা পরিশুদ্ধির ব্যাপারে কর্মতৎপর হয়।
﴿وَالَّذِيْنَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُوْنَ﴾
যাকাত দেয়া ও যাকাতের পথে কর্মতৎপর বা সক্রিয় হওয়ার মধ্যে অর্থের দিক দিয়ে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান।
মু’মিনদের বৈশিষ্ট্য হিসাবে কুরআনে বিশেষ ধরনের অর্থের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
এটা বলার পেছনে তাৎপর্য : আরবী ভাষায় যাকাত শব্দের দু’টি অর্থ বিদ্যমান।
১। পবিত্রতা, পরিশুদ্ধতা, পরিশুদ্ধি।
২। বিকাশ সাধন, কোন জিনিসের সাধনে যেসব জিনিস প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় সেসব দূর করা এবং তার মৌলবস্তুকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করা।
যাকাতের আরো অর্থ রয়েছে। যেমন-
১. আত্মার পরিশুদ্ধি, ২. চরিত্রের পরিশুদ্ধি, ৩. জীবনের পরিশুদ্ধি, ৪. তার পারিবারিক পরিশুদ্ধি, ৫. নিজের, সমাজ এবং রাষ্ট্রের পরিশুদ্ধি, ৬. অর্থের পরিশুদ্ধি।
উপরোক্ত প্রত্যেকটি দিকের পরিশুদ্ধি পর্যন্ত এর ব্যপ্তি ছড়িয়ে পড়বে। এছাড়া এর অর্থ কেবল নিজেরই জীবনের পরিশুদ্ধি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং নিজের চারপাশের জীবনের পরিশুদ্ধি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়বে। কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى وَذَكَرَ اسْمَ رَبِّهِ فَصَلَّى﴾
“কল্যাণ ও সফলতা লাভ করল সে, যে পবিত্রতার কাজ করল এবং নিজের রবের নাম স্মরণ করে সালাত আদায় করল।” আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا﴾
“সফলকাম হলো সে, যে নিজের নফসকে পবিত্র বা তাযকিয়া করলো। আর ব্যর্থ হলো সে যে নিজেকে কলুষিত করল।”
এ আয়াতে গোটা সমাজ জীবনের কথা বলা হয়েছে।
চতুর্থ গুণ : ‘যারা লজ্জাস্থানের হিফাযত করেন।’
﴿وَالَّذِيْنَ هُمْ لِفُرُوْجِهِمْ حَافِظُوْنَ﴾
তবে তাদের স্ত্রীদের এবং মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে সংযত না করলে তারা তিরস্কৃত হবে না। তবে কেউ যদি এদের ছাড়া অন্য কাউকে কামনা করে তবে এ ক্ষেত্রে তারা হবে সীমালঙ্ঘনকারী।
লজ্জাস্থান হিফাযত করার দু’টি অর্থ হতে পারে।
১) নিজের লজ্জাস্থান ঢেকে রাখা।
২) যৌন শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে লাগামহীন না হওয়া।
এটি প্রাসঙ্গিক বাক্য। “লজ্জাস্থানের হিফাযত করে।” বাক্য থেকে সৃষ্ট বিভ্রান্তি দূর করার জন্য।
লজ্জাস্থানের সাধারণ হুকুম থেকে দু’ধরনের লোককে বাদ দেয়া হয়েছে।
১. স্ত্রী অর্থাৎ- যেসব নারীকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করা হয়েছে।
২. দাসী অর্থাৎ- এমন বাদী যার উপর মানুষের মালিকানা অধিকার আছে। সুতরাং মালিকানাধীন দাসীদের যৌনসম্পর্ক বৈধ এবং বৈধতার ভিত্তি বিয়ে নয়। কারণ এখানে স্ত্রী ও দাসী আলাদাভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
এ বাক্যটি উপরোক্ত দু’টি পন্থা ছাড়া কামনা চরিতার্থ করার যাবতীয় পথ অবৈধ করেছে। হারাম উপায়গুলো :
১. যিনা যেমন হারাম তেমনি হারাম নারীকে বিয়ে করাও যিনার মধ্যে গণ্য।
২. স্ত্রী অথবা দাসীর সাথে হায়িয-নিফাস অবস্থায় কিংবা অস্বাভাবিক পন্থায় সহবাসে লিপ্ত হওয়া।
৩. পুরুষ, বালক বা জীবজন্তুর সাথে কামনা চরিতার্থ করা।
৪. অধিকাংশ তাফসীরবিদগণের মতে হস্তমৈথুন এর অন্তর্ভুক্ত।
৫. এছাড়া যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোন অশ্লীল-বই পড়া, ছবি দেখা।
উপরোক্ত সবকিছুই সীমালংঘনের মধ্যে গণ্য হবে।
৫ম ও ৬ষ্ঠ গুণ : ‘যারা তাদের আমানতসমূহ এবং ওয়াদা বা প্রতিশ্রতি রক্ষা করে।’
﴿وَالَّذِيْنَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُوْنَ﴾
আমানত প্রত্যার্পন করা : আমানত শব্দের অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। আভিধানিক অর্থে এমন একটি বিষয় যার দায়িত্ব কোন ব্যক্তি বহন করে এবং সে বিষয়ে কোন ব্যক্তির উপর আস্থা রাখা যায় ও ভরসা করা যায়, বিধায় আমানত শব্দটি বহুবচন অর্থে ব্যবহৃত।
দু’ধরনের আমানত সংক্রান্ত কথাÑ
১. হাক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক্ব।
২. হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক্ব।
১) হাক্কুল্লাহ : শরী‘আত আরোপিত সকল র্ফয ও ওয়াজিব পালন করা এবং যাবতীয় হারাম ও মাকরুহ বিষয় থেকে দূরে থাকা।
মানুষ মহান আল্লাহর খলিফা। খিলাফতের দায়িত্ব পালনের আমানত রক্ষা করা।
২) হাক্কুল ইবাদ :
১. কোন ব্যক্তি বা সংগঠন কর্তৃক আরোপিত ধন-সম্পদের আমানত।
২. গোপন কথার আমানত।
৩. মজুর, শ্রমিক ও চাকরীজীবীদের জন্য যে কার্য সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয় তা পালন।
৪. দায়-দায়িত্বের আমানত। সংগঠন, ব্যক্তি, রাষ্ট্র, পরিবার পরিচালক হিসেবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوْا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا﴾
“আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় আমানত তার হক্বদারদের হাতে ফেরত দেবার নির্দেশ দিচ্ছেন।”
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন :
لَا إِيْمَانَ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ لَه.
“তার ঈমান নেই যার আমানতদারীতা নেই।”
তাছাড়া মুনাফিক্বের যে চারটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে তন্মধ্যে একটি হচ্ছেÑ
১) ‘কোন আমানত তার কাছে সোপর্দ করা হলে সে তার খেয়ানত করে।’
অঙ্গীকার পূর্ণ করা : অঙ্গীকার বলতে প্রথমত, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বুঝায় যা কোন ব্যাপারে উভয়পক্ষ অপরিহার্য করে নেয়। এরূপ চুক্তি পূর্ণ করা র্ফয।
দ্বিতীয় প্রকার অঙ্গীকারকে ওয়া‘দা বলা হয় অর্থাৎ- এক তরফাভাবে একজন অন্যজনকে কিছু দেয়ার বা কোন কাজ করে দেয়ার অঙ্গীকার করা।
হাদীসে আছেÑ “ওয়া‘দাও এক প্রকার কসম।”
সপ্তম গুণ : “যারা তাদের সালাতসমূহকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে।”
﴿وَالَّذِيْنَ هُمْ عَلٰى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُوْنَ﴾
এখানে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত মুস্তাহাব বা আউয়াল ওয়াক্তে যথাযথভাবে পাবন্দী সহকারে আদায় করা বুঝায়।
এখানে সালাতসমূহের সংরক্ষণ বলতে সালাতের বাইরের এবং ভেতরের যাবতীয় নিয়মনীতি যথাযথভাবে পালন করা। অর্থাৎ- আরকান-আহকাম পালনÑ
১। শরীর, পোশাক, পরিচ্ছদ পাক পবিত্র রাখা।
২। যথা সময়ে সালাত আদায় করা।
৩। ওযূ সঠিকভাবে করে সালাত আদায় করা।
৪। জামা‘আতের সাথে সালাত আদায় করা।
৫। শুদ্ধ, ধীরস্থিরভাবে দু‘আ কালাম পাঠ করা।
৬। সালাত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সালাতের হিফাযত করা।
৭। ইহসানের সাথে সালাত আদায় করা।
কুরআনে এসেছেÑ
﴿إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ﴾
“নিশ্চয়ই সালাত মানুষকে অশ্লীল, অপকর্ম থেকে বিরত রাখে।”
﴿أُوْلَٰئِكَ هُمُ الْوَارِثُوْنَ الَّذِيْنَ يَرِثُوْنَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيْهَا خَالِدُوْنَ﴾
তারাই উত্তরাধিকার লাভ করবে। তারা উত্তরাধিকার হিসেবে ফেরদাউস পাবে এবং সেখানে চিরদিন থাকবে।
এখানে উত্তরাধিকারী বলা হয়েছে এজন্য যে মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পদ যেমন উত্তরাধিকারদের নিশ্চিত প্রাপ্য। আর গুণের অধিকারীদেরও জান্নাতে প্রবেশ সুনিশ্চিত।
সফলকাম ব্যক্তিদের গুণাবলী পুরোপুরি উল্লেখ করার পর এই বাক্যে আরও ইঙ্গিত আছে যে পূর্ণাঙ্গ সফল জান্নাতী ব্যক্তি।
الْفِرْدَوْس শব্দটি এমন একটি বাগানের জন্য বলা হয়ে থাকে যার চারিদিকে প্রাচীর দেয়া থাকে। বাগানটি বিস্তৃত হয়। মানুষের আবাস গৃহের সাথে সংযুক্ত হয় এবং সব ধরনের ফল বিশেষ করে আঙ্গুর পাওয়া যায়। কোন কোন ভাষায় এর অর্থের মধ্যে এ কথাও বোঝায় যে এখানে বাছাই করা গৃহপালিত পশু পাখি পাওয়া যায়।
কুরআনে বিভিন্ন সমষ্টিকে ফিরদাউস বলা হয়েছে।
“তাদের আপ্যায়নের জন্য ফিরদাউসের বাগানগুলো আছে।”
এ থেকে মনের মধ্যে এ ধারণা জন্মে যে ফিরদৌস একটা বড় জায়গা, যেখানে অসংখ্য বাগ বাগিচা উদ্যান রয়েছে।
র্দাস থেকে শিক্ষণীয় বিষয় :
১। নিছক পার্থিব ও বৈষয়িক প্রাচুর্য ও সম্পদশালীতা এবং সীমিত সাফল্যের নাম সফলতা নয়। আখিরাতের স্থায়ী সাফল্যই প্রকৃত সাফল্য।
২। খুশু-খুযূর সাথে সালাত আদায় করা এবং আউয়াল ওয়াক্তে নিয়মিত সালাত আদায়ে অভ্যস্ত হওয়া।
৩। বাজে কথা ও কাজে সময় নষ্ট না করা।
৪। সর্ববস্থায় নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে সচেষ্ট হওয়া।
৫। অবৈধ পন্থায় কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার চিন্তাও না করা।
৬। আমানতের হিফাযত করা এবং অঙ্গীকার বা ওয়া‘দা যথাযথভাবে পালন করা। ###
মণির খনি
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
“তিনি নাযিল করেন বৃষ্টি এবং তিনি জানেন, যা রয়েছে মাতৃগর্ভে। জানে না কেউ, কি কামাই করবে সে আগামীকাল। আর জানে না কেউ, কোন মাটিতে (দেশে) সে মারা যাবে, নিশ্চয় আল্লাহ সব জানেন, সব খবর রাখেন।”
তারপর আগন্তুক উঠে চলে গেলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবীদের বললেন :
“তাঁকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনো। তাঁকে তালাশ করা হলো, কিন্তু তাঁকে পাওয়া গেল না। তারপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন : ইনি জিবরা-ঈল (‘আলাইহিস্ সালাম)। তোমরা প্রশ্ন না করায়, তিনি চাইলেন যেনো তোমরা দীন সন্বন্ধে জ্ঞান লাভ করো।”
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বাণী :
আবূ ইয়াহইয়া উসাইদ ইবনু হুদাইর (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) থেকে বর্ণিত। এক আনসারী বলল, ‘হে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আপনি কি আমাকে কর্মচারী নিযুক্ত করবেন না, যেমন উমুককে করেছেন? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, “তোমরা অনতিবিলম্বে আমার পরে (তোমাদের নিজেদের ওপর) অন্যের গুরুত্ব দেখতে পাবে। তখন আমার সাথে হাওযে কাউসারে দেখা না হওয়া পর্যন্ত সবর করবে।”
সত্যনিষ্ঠা :
১। “হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যনিষ্ঠাদের সাথে থাকো।”
২। “সত্যনিষ্ঠা পুরুষ ও নারীগণ আল্লাহ তাদের জন্য ক্ষমা ও বিরাট পুরস্কার প্রস্তুত করে রেখেছেন।”
৩। “যদি তারা আল্লাহর নিকট ওয়া‘দায় সত্যতার প্রমাণ দিত, তাহলে তাদের জন্যই তা ভাল হত।
সূরা আল মু’মিনূন ২৩ : ১-১১।
. আত্ তিরমিযী।
. মুসনাদ আহমাদ।
. তাফসীর ইবনু কাসীর।
. সূরা আল আ‘লা : ১৬, ১৭।
. আন্ নাসায়ী, সুনান আবূ দাঊদ।
. আত্ তিরমিযী।
. সূরা আল ফুরক্বা-ন- ৭২।
. সূরা আল আ‘লা : ১৪, ১৫।
. সূরা আশ্ শাম্স : ৯, ১০।
. সূরা আন্ নিসা : ৫৮।
. মুসনাদ আহমাদ।
. সহীহুল বুখারী।
. সূরা আল ‘আনকাবূত : ৪৫।
সূরা লুক্বমা-ন ৩১ : ৩৪।
সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম।
সূরা আত্ তাওবাহ্ ৯ : ১১৯।
সূরা আল আহ্যা-ব ৩৩ : ৩৫।
সূরা মুহাম্মদ ৪৭ : ২১।
আপনার মন্তব্য1