আল কুরআনুল হাকীম
কুরবানী তাক্বওয়া অর্জনের অনন্য মাধ্যম
অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মাদ রঈসুদ্দীন
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿لَنْ یَّنَالَ اللّٰهَ لُحُوْمُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلٰكِنْ یَّنَالُهُ التَّقْوٰى مِنْكُمْ ----- وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِیْنَ﴾
অনুবাদ : “আল্লাহর কাছে ওগুলোর না গোশ্ত পৌঁছে, আর না রক্ত পৌঁছে বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাক্বওয়া। কাজেই সৎকর্মশীলদের তুমি সুসংবাদ দাও।[১]
আলোচ্য আয়াতটি অবতরণের প্রেক্ষাপট
ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে জাহিলী মানুষেরা উট যবাহ করার পরে তার রক্ত ও গোশত কা‘বা ঘরের চারদিকে ছিটাতো। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাহাবীগণ বলেন, আমরাই তাদের তুলনায় এ কাজের অধিক উপযুক্ত। ফলে আল্লাহ অত্র আয়াতটি নাযিল করে এক মহা সত্যের বিবরণ দিয়েছেন।
আলোচ্য বিষয় : মহান আল্লাহর নিকট মানুষের বাহ্যিক কোন কিছুর মূল্য নেই। বরং অভ্যন্তরীন মনের ইচ্ছাটাই ধর্তব্য। অনুরূপভাবে কুরবানীর পশু যার বাহ্যিক বস্তু গোশত ও রক্তের কোন মূল্য মহান আল্লাহর কাছে নেই। আর কুরবানী দাতার মনের ইচ্ছা লোক দেখানো না রব্বের জন্যে সেটাই লক্ষ্যণীয় বিষয়। বিধায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তার নিকট কুরবানীর গোশত ও রক্ত যায় না। তবে মানুষের নিয়ত মহান আল্লাহর নিকট পৌঁছে।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ : অত্র আয়াতের পূর্বের আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা কুরবানীর বিধানের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। অতঃপর এ আয়াতে তিনি সে বিধানটি কার্যকরী ও সত্যায়িত হওয়ার মাধ্যম- উপকরণের বর্ণনা দিয়েছেন। আর সকল ‘আমল কবূল হওয়ার যে মৌলিক বিধান রয়েছে তা এখানেও বাস্তবায়ন করতে হবে। অর্থাৎ- ইখলাস, স্বচ্ছ নিয়ত ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পদ্ধতি অনুসরণ করা। এমনটিই ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿لَنْ یَّنَالَ اللّٰهَ لُحُوْمُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا﴾
“আল্লাহর কাছে ওগুলোর না গোশত পৌঁছে, আর না রক্ত পৌঁছে।”
তবে যা দরকার বান্দার জন্যে তা তিনি স্পষ্ট করে দেন। আর তা হচ্ছে-
﴿وَلٰكِنْ یَّنَالُهُ التَّقْوٰى مِنْكُمْ﴾
“বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাক্বওয়া।”
অর্থাৎ- আল্লাহ ভীরুতাই কবূলের মূল কারণ এবং এর ওপর ভিত্তি করেই ‘আমলসমূহের পুরস্কার নির্ধারণ হবে।[২]
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন :
إِنَّ اللهَ لَا يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوْبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ.
‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের আকৃতি ও ধন-সম্পদের দিকে দৃষ্টিপাত করবেন না। বরং তিনি তোমাদের অন্তরিস্থ নিয়ত ও ‘আমলসমূহের প্রতি লক্ষ্য করবেন।’[৩]
আলোচ্য হাদীস থেকে স্বাভাবিকভাবেই আমরা বুঝতে পারি যে, প্রত্যেক ‘আমলের মূল হচ্ছে নিয়্যাত বা ইখলাস। আর এভাবেই ‘আমলগুলো হাসানা বা সৎ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বিধায় আল্লাহ তা‘আলা আয়াতের শেষে বলেন :
﴿وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِیْنَ﴾
“আর সৎকর্মশীলদের তুমি সুসংবাদ দাও।”
এ ব্যাপারে ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন, অর্থাৎ- ‘আমল কবূল হওয়ার নিয়মাবলী অনুযায়ী ‘আমল বাস্তবায়নকারীদেরকে হে মুহাম্মাদ (সা)! আপনি সু-সংবাদ দিন।
কুরবানীর ইতিবৃত্ত
কুরবানীর ইতিহাস খুবই প্রাচীন। আদি পিতা আদম (‘আলাইহিস্ সালাম)-এর সময় থেকেই কুরবানীর বিধান চলে আসছে। নিম্নে প্রমাণসহকারে কিছু নমুনা তুলে ধরা হলো-
১. আদম (‘আলাইহিস্ সালাম)-এর দুই ছেলে হাবীল ও কাবীলের কুরবানী : আদম (‘আলাইহিস্ সালাম)-এর পুত্রদ্বয়ের কুরবানী সংক্রান্ত বিষয়ের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿وَاتْلُ عَلَیْهِمْ نَبَاَ ابْنَیْ اٰدَمَ بِالْحَقِّ١ۘ اِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ اَحَدِهِمَا وَ لَمْ یُتَقَبَّلْ مِنَ الْاٰخَرِؕ قَالَ لَاَقْتُلَنَّكَؕ قَالَ اِنَّمَا یَتَقَبَّلُ اللّٰهُ مِنَ الْمُتَّقِیْنَ﴾
“আদমের দু’পুত্রের খবর তাদের সঠিকভাবে জানিয়ে দাও। উভয়ে যখন একটি করে কুরবানী হাজির করেছিলো তখন তাদের একজনের নিকট থেকে কবূল করা হলো। অন্যজনের নিকট থেকে কবূল করা হলো না। সে বললো, আমি তোমাকে অবশ্য অবশ্যই হত্যা করবো। অন্যজন বললো, ‘আল্লাহ কেবল মুত্তাকীদের কুরবানী কবূল করেন’।”[৪]
২. ইব্রা-হীম (‘আলাইহিস্ সালাম)-এর কুরবানী : পিতা ও পুত্রের কুরবানী বিষয়ক ঐতিহাসিক তথ্যের বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْیَ قَالَ یٰبُنَیَّ اِنِّیْۤ اَرٰى فِیْ الْمَنَامِ اَنِّیْۤ اَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَا ذَا تَرٰىؕ قَالَ یٰۤاَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِیْۤ اِنْ شَآءَ اللّٰهُ مِنَ الصّٰبِرِیْنَ﴾
“তারপর সে যখন তার পিতার সাথে চলাফিরা করার বয়সে পৌঁছলো, তখন ইব্রা-হীম বললো, ‘বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি, এখন বলো, তোমার অভিমত কী? সে বললো, ‘হে পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন, আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলই পাবেন।”[৫]
৩. কুরবানীর বিধান নতুন নয় : মূলতঃ কুরবানীর বিধান সকল উম্মাতের জন্য একটি ধর্মীয় বিধান হিসেবে বহাল ছিলো। বিধায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿وَلِكُلِّ اُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِّیَذْكُرُوْا اسْمَ اللّٰهِ عَلٰى مَا رَزَقَهُمْ مِّنْۢ بَهِیْمَةِ الْاَنْعَامِؕ فَاِلٰهُكُمْ اِلٰهٌ وَّاحِدٌ فَلَهٗۤ اَسْلِمُوْاؕ وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِیْنَۙ﴾
“আমি প্রতিটি সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানীর নিয়ম করে দিয়েছি। তাদের চতুষ্পদ জন্তু থেকে যে রিয্ক দেয়া হয়েছে সেগুলোর ওপর তারা যেন আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে, এই বিভিন্ন নিয়ম-পদ্ধতির মূল লক্ষ্য কিন্তু এক- আল্লাহর নির্দেশ পালন, কারণ তোমাদের উপাস্য একমাত্র উপাস্য। কাজেই তাঁর কাছেই আত্মসমর্পণ করো আর সুসংবাদ দাও সেই বিনীতদের।”[৬]
সুতরাং আমরা কোনরূপ সন্দেহ ছাড়াই বলতে পারি কুরবানীর বিধান আদি পিতা আদম (‘আলাইহিস্ সালাম) থেকে নিয়ে শেষ নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সময় পর্যন্ত সকল জাতীর জন্য আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক স্বীকৃত একটি উত্তম ‘ইবাদত।
কুরবানীর গুরুত্ব ও তাৎপর্য্য
আল্লাহ তা‘আলা তার নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে শরী‘আতের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ‘ইবাদত সালাতের সাথে কুরবানীর বিধান বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন। ফলে সহজেই বুঝা যায় কুরবানীর ফযীলত ও তার গুরুত্ব স¤পর্কে তথা আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَ انْحَرْ﴾
“কাজেই তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো এবং কুরবানী করো।”[৭]
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :
﴿قُلْ اِنَّ صَلَاتِیْ وَ نُسُكِیْ وَمَحْیَایَ وَمَمَاتِیْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ﴾
“বলো, আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সব কিছুই (যাবতীয় ‘ইবাদত) বিশ্বজগতের প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্যই নিবেদিত।”[৮]
এছাড়াও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বাণী থেকে কুরবানীর ব্যাপক ফযীলত বুঝা যায়। যথা-
১. ইবনু ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) বলেন, নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দশ বছর মাদীনায় অবস্থানকালে কুরবানী করেছেন।[৯]
২. আনাস (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দীর্ঘ (ও সুন্দর) শিং বিশিষ্ট সাদা-কালো মিশ্রিত মেটে বা ছাই রঙ্গের দু’টি দুম্বা কুরবানী করেছেন।[১০]
৩. যেমন তিনি কর্ম দ্বারা কুরবানী করতে উম্মাতকে অনুপ্রাণিত করেছেন তেমনি বাক্য দ্বারাও উদ্বুদ্ধ ও তাকীদ করেছেন। যেমন- মহানাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
যে ব্যক্তি ঈদের সালাতের পূর্বেই যবেহ করে সে তার নিজের জন্যই যবেহ করলো। আর যে সালাতের পর যবেহ করে তার কুরবানীই কেবল সিদ্ধ হয়। আর সে ব্যক্তি মুসলিমদের তরীকার অনুসারী হয়।[১১]
৪. মহানাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানী করে না, সে যেন অবশ্যই আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।[১২]
এছাড়াও বিভিন্ন বর্ণনায় কুরবানীর ফযীলতের আলোচনা রয়েছে।
আলোচ্য আয়াত থেকে শিক্ষনীয় বিষয়সমূহ
১. আল্লাহর চাওয়া মানুষের চাওয়া থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বা ব্যতিক্রম।
২. আল্লাহর নিকট কুরবানীর গোশত ও রক্ত ধর্তব্য নয়।
৩. অনেক মানুষের নিকট গোশতই ধর্তব্য; অন্য কিছুই নয়।
৪. আল্লাহর নিকট মানুষের চেহারা ও ধন-সম্পদের কোনো গুরুত্ব নেই, গুরুত্ব শুধু ‘আমলেরই।
৫. ‘আমলের মূল স্তম্ভ ইখলাস যা ব্যতীত ‘আমলের ফলাফল শুন্য।
৬. আল্লাহর নিকট ‘আমলের মানদ- নির্ণয় হয় মানুষের তাক্বওয়া অনুযায়ী।
৭. কুরবানী প্রদানকারী ব্যক্তির কুরবানী কবূল হওয়ার জন্যে নিয়্যাতটাই যথেষ্ট।
৮. আল্লাহভীতি না থাকলে অর্থাৎ- কুরবানী খালেস নিয়তে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা না হলে তা কবুল হয় না।
৯. আল্লাহভীতি বা তাক্বওয়া শুধু কুরবানী কবুল হওয়ার পূর্ব শর্ত নয়, যে কোন ‘ইবাদত কবুল হওয়া বা আদর্শ মুসলিম তথা প্রকৃত মানুষ হওয়ারও পূর্বশর্ত।
১০. তাক্বওয়ার জীবন্ত প্রতীক ছিলেন আল্লাহর নাবী-রাসূলগণ। যুগে যুগে তাঁদেরকে অনুসরণ করে একদল লোক প্রকৃত মু’মিন বা আদর্শ মানুষে পরিণত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
১১. কুরবানীর ক্ষেত্রে তাক্বওয়ার সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ রেখেছেন মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইব্রা-হীম (‘আলাইহিস্ সালাম), ইসমা‘ঈল (‘আলাইহিস্ সালাম) এবং হাজেরা (‘আলাইহিস্ সালাম)।
১২. প্রাক ইসলামী যুগে মানুষ কুরবানী করার পর কুরবানীর পশুর গোশ্ত আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্যে নিবেদন করার জন্য কা‘বা ঘরের সামনে রেখে দিত, পশুর রক্ত কা‘বার দেয়ালে লেপটে দিত। সূরা আল হাজ্জ-এর পূর্বোদ্ধৃত ৩৭ নং আয়াতে এ কুপ্রথার মূলোৎপাটন করে সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়া হয়েছে-
﴿لَنْ يَنَالَ اللهَ لُحُوْمُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ كَذَلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوْا اللهَ عَلٰى مَا هَدَاكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِيْنَ﴾
“কুরবানীর পশুর রক্ত-মাংসের কোন প্রয়োজন আল্লাহর নেই, তিনি যা চান তাহলো কুরবানীকারীর তাক্বওয়া, আল্লাহর প্রতি একান্ত আনুগত্য ও আল্লাহর প্রতি মু’মিন-চিত্তের একাগ্রতা।”
১৩. একথা সুবিদিত যে, লোভ, মোহ, স্বার্থপরতা ও কুপ্রবৃত্তির মধ্যে কখনো তাক্বওয়া বা আল্লাহ-সচেতনতা সৃষ্টি হয় না। অতএব, কুরবানী আমাদেরকে এসব মানবিক দুবর্লতার ঊর্ধ্বে ওঠার শিক্ষা দেয়।
১৪. হাজ্জ উপলক্ষে যেমন একমাত্র মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে পার্থিব সকল কিছু বিসর্জন দিয়ে মক্কায় সমবেত হতে হয়, কুরবানীও তেমনি শুধু মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে ইব্রা-হীম (‘আলাইহিস্ সালাম) তাঁর প্রাণাধিক পুত্রকে কুরবানী করতে উদ্যত হয়ে যে চরম আত্মত্যাগের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন সে মহান স্মৃতিকে স্মরণ করে প্রতি বছর পশু কুরবানী করে মু’মিনদেরকে মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগের পরীক্ষা দিতে হয়।
উপসংহার : পবিত্র হাজ্জ, ঈদ-উল-আযহা ও কুরবানী প্রতি বছর আমাদের জন্য বহন করে আনে অপরিসীম আত্মত্যাগের সুমহান বার্তা। এ উপলক্ষে আমরা আত্মত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের মাধ্যমে একাধারে মহান স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বজনীন মানবিক মূল্যবোধ ও কল্যাণ-চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হতে পারি। এর প্রত্যেকটিই গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ‘ইবাদত।
একমাত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই এর লক্ষ্য। কোনরূপ প্রদর্শনেচ্ছা, পার্থিব ফায়দা হাসিলের মনোভাব যেন এর মধ্যে স্থান লাভ করতে না পারে। ‘ইন্না সালাতি ওয়ানুসুকি ওয়া মাহ্ইয়া ইয়া ওয়ামামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’- অর্থাৎ- আমার সালাত, কুরবানী তথা সকল ‘ইবাদত একমাত্র মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যেই নিবেদিত হোক! আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে এরূপ গুরুত্বপূর্ণ ‘ইবাদত পালন করার তাওফীক্ব দান করুন -আমীন।
﴿لَنْ یَّنَالَ اللّٰهَ لُحُوْمُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلٰكِنْ یَّنَالُهُ التَّقْوٰى مِنْكُمْ ----- وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِیْنَ﴾
অনুবাদ : “আল্লাহর কাছে ওগুলোর না গোশ্ত পৌঁছে, আর না রক্ত পৌঁছে বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাক্বওয়া। কাজেই সৎকর্মশীলদের তুমি সুসংবাদ দাও।[১]
আলোচ্য আয়াতটি অবতরণের প্রেক্ষাপট
ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে জাহিলী মানুষেরা উট যবাহ করার পরে তার রক্ত ও গোশত কা‘বা ঘরের চারদিকে ছিটাতো। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাহাবীগণ বলেন, আমরাই তাদের তুলনায় এ কাজের অধিক উপযুক্ত। ফলে আল্লাহ অত্র আয়াতটি নাযিল করে এক মহা সত্যের বিবরণ দিয়েছেন।
আলোচ্য বিষয় : মহান আল্লাহর নিকট মানুষের বাহ্যিক কোন কিছুর মূল্য নেই। বরং অভ্যন্তরীন মনের ইচ্ছাটাই ধর্তব্য। অনুরূপভাবে কুরবানীর পশু যার বাহ্যিক বস্তু গোশত ও রক্তের কোন মূল্য মহান আল্লাহর কাছে নেই। আর কুরবানী দাতার মনের ইচ্ছা লোক দেখানো না রব্বের জন্যে সেটাই লক্ষ্যণীয় বিষয়। বিধায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তার নিকট কুরবানীর গোশত ও রক্ত যায় না। তবে মানুষের নিয়ত মহান আল্লাহর নিকট পৌঁছে।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ : অত্র আয়াতের পূর্বের আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা কুরবানীর বিধানের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। অতঃপর এ আয়াতে তিনি সে বিধানটি কার্যকরী ও সত্যায়িত হওয়ার মাধ্যম- উপকরণের বর্ণনা দিয়েছেন। আর সকল ‘আমল কবূল হওয়ার যে মৌলিক বিধান রয়েছে তা এখানেও বাস্তবায়ন করতে হবে। অর্থাৎ- ইখলাস, স্বচ্ছ নিয়ত ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পদ্ধতি অনুসরণ করা। এমনটিই ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿لَنْ یَّنَالَ اللّٰهَ لُحُوْمُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا﴾
“আল্লাহর কাছে ওগুলোর না গোশত পৌঁছে, আর না রক্ত পৌঁছে।”
তবে যা দরকার বান্দার জন্যে তা তিনি স্পষ্ট করে দেন। আর তা হচ্ছে-
﴿وَلٰكِنْ یَّنَالُهُ التَّقْوٰى مِنْكُمْ﴾
“বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাক্বওয়া।”
অর্থাৎ- আল্লাহ ভীরুতাই কবূলের মূল কারণ এবং এর ওপর ভিত্তি করেই ‘আমলসমূহের পুরস্কার নির্ধারণ হবে।[২]
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন :
إِنَّ اللهَ لَا يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوْبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ.
‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের আকৃতি ও ধন-সম্পদের দিকে দৃষ্টিপাত করবেন না। বরং তিনি তোমাদের অন্তরিস্থ নিয়ত ও ‘আমলসমূহের প্রতি লক্ষ্য করবেন।’[৩]
আলোচ্য হাদীস থেকে স্বাভাবিকভাবেই আমরা বুঝতে পারি যে, প্রত্যেক ‘আমলের মূল হচ্ছে নিয়্যাত বা ইখলাস। আর এভাবেই ‘আমলগুলো হাসানা বা সৎ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বিধায় আল্লাহ তা‘আলা আয়াতের শেষে বলেন :
﴿وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِیْنَ﴾
“আর সৎকর্মশীলদের তুমি সুসংবাদ দাও।”
এ ব্যাপারে ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন, অর্থাৎ- ‘আমল কবূল হওয়ার নিয়মাবলী অনুযায়ী ‘আমল বাস্তবায়নকারীদেরকে হে মুহাম্মাদ (সা)! আপনি সু-সংবাদ দিন।
কুরবানীর ইতিবৃত্ত
কুরবানীর ইতিহাস খুবই প্রাচীন। আদি পিতা আদম (‘আলাইহিস্ সালাম)-এর সময় থেকেই কুরবানীর বিধান চলে আসছে। নিম্নে প্রমাণসহকারে কিছু নমুনা তুলে ধরা হলো-
১. আদম (‘আলাইহিস্ সালাম)-এর দুই ছেলে হাবীল ও কাবীলের কুরবানী : আদম (‘আলাইহিস্ সালাম)-এর পুত্রদ্বয়ের কুরবানী সংক্রান্ত বিষয়ের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿وَاتْلُ عَلَیْهِمْ نَبَاَ ابْنَیْ اٰدَمَ بِالْحَقِّ١ۘ اِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ اَحَدِهِمَا وَ لَمْ یُتَقَبَّلْ مِنَ الْاٰخَرِؕ قَالَ لَاَقْتُلَنَّكَؕ قَالَ اِنَّمَا یَتَقَبَّلُ اللّٰهُ مِنَ الْمُتَّقِیْنَ﴾
“আদমের দু’পুত্রের খবর তাদের সঠিকভাবে জানিয়ে দাও। উভয়ে যখন একটি করে কুরবানী হাজির করেছিলো তখন তাদের একজনের নিকট থেকে কবূল করা হলো। অন্যজনের নিকট থেকে কবূল করা হলো না। সে বললো, আমি তোমাকে অবশ্য অবশ্যই হত্যা করবো। অন্যজন বললো, ‘আল্লাহ কেবল মুত্তাকীদের কুরবানী কবূল করেন’।”[৪]
২. ইব্রা-হীম (‘আলাইহিস্ সালাম)-এর কুরবানী : পিতা ও পুত্রের কুরবানী বিষয়ক ঐতিহাসিক তথ্যের বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْیَ قَالَ یٰبُنَیَّ اِنِّیْۤ اَرٰى فِیْ الْمَنَامِ اَنِّیْۤ اَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَا ذَا تَرٰىؕ قَالَ یٰۤاَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِیْۤ اِنْ شَآءَ اللّٰهُ مِنَ الصّٰبِرِیْنَ﴾
“তারপর সে যখন তার পিতার সাথে চলাফিরা করার বয়সে পৌঁছলো, তখন ইব্রা-হীম বললো, ‘বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি, এখন বলো, তোমার অভিমত কী? সে বললো, ‘হে পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন, আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলই পাবেন।”[৫]
৩. কুরবানীর বিধান নতুন নয় : মূলতঃ কুরবানীর বিধান সকল উম্মাতের জন্য একটি ধর্মীয় বিধান হিসেবে বহাল ছিলো। বিধায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿وَلِكُلِّ اُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِّیَذْكُرُوْا اسْمَ اللّٰهِ عَلٰى مَا رَزَقَهُمْ مِّنْۢ بَهِیْمَةِ الْاَنْعَامِؕ فَاِلٰهُكُمْ اِلٰهٌ وَّاحِدٌ فَلَهٗۤ اَسْلِمُوْاؕ وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِیْنَۙ﴾
“আমি প্রতিটি সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানীর নিয়ম করে দিয়েছি। তাদের চতুষ্পদ জন্তু থেকে যে রিয্ক দেয়া হয়েছে সেগুলোর ওপর তারা যেন আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে, এই বিভিন্ন নিয়ম-পদ্ধতির মূল লক্ষ্য কিন্তু এক- আল্লাহর নির্দেশ পালন, কারণ তোমাদের উপাস্য একমাত্র উপাস্য। কাজেই তাঁর কাছেই আত্মসমর্পণ করো আর সুসংবাদ দাও সেই বিনীতদের।”[৬]
সুতরাং আমরা কোনরূপ সন্দেহ ছাড়াই বলতে পারি কুরবানীর বিধান আদি পিতা আদম (‘আলাইহিস্ সালাম) থেকে নিয়ে শেষ নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সময় পর্যন্ত সকল জাতীর জন্য আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক স্বীকৃত একটি উত্তম ‘ইবাদত।
কুরবানীর গুরুত্ব ও তাৎপর্য্য
আল্লাহ তা‘আলা তার নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে শরী‘আতের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ‘ইবাদত সালাতের সাথে কুরবানীর বিধান বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন। ফলে সহজেই বুঝা যায় কুরবানীর ফযীলত ও তার গুরুত্ব স¤পর্কে তথা আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَ انْحَرْ﴾
“কাজেই তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো এবং কুরবানী করো।”[৭]
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :
﴿قُلْ اِنَّ صَلَاتِیْ وَ نُسُكِیْ وَمَحْیَایَ وَمَمَاتِیْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ﴾
“বলো, আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সব কিছুই (যাবতীয় ‘ইবাদত) বিশ্বজগতের প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্যই নিবেদিত।”[৮]
এছাড়াও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বাণী থেকে কুরবানীর ব্যাপক ফযীলত বুঝা যায়। যথা-
১. ইবনু ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) বলেন, নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দশ বছর মাদীনায় অবস্থানকালে কুরবানী করেছেন।[৯]
২. আনাস (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দীর্ঘ (ও সুন্দর) শিং বিশিষ্ট সাদা-কালো মিশ্রিত মেটে বা ছাই রঙ্গের দু’টি দুম্বা কুরবানী করেছেন।[১০]
৩. যেমন তিনি কর্ম দ্বারা কুরবানী করতে উম্মাতকে অনুপ্রাণিত করেছেন তেমনি বাক্য দ্বারাও উদ্বুদ্ধ ও তাকীদ করেছেন। যেমন- মহানাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
যে ব্যক্তি ঈদের সালাতের পূর্বেই যবেহ করে সে তার নিজের জন্যই যবেহ করলো। আর যে সালাতের পর যবেহ করে তার কুরবানীই কেবল সিদ্ধ হয়। আর সে ব্যক্তি মুসলিমদের তরীকার অনুসারী হয়।[১১]
৪. মহানাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানী করে না, সে যেন অবশ্যই আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।[১২]
এছাড়াও বিভিন্ন বর্ণনায় কুরবানীর ফযীলতের আলোচনা রয়েছে।
আলোচ্য আয়াত থেকে শিক্ষনীয় বিষয়সমূহ
১. আল্লাহর চাওয়া মানুষের চাওয়া থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বা ব্যতিক্রম।
২. আল্লাহর নিকট কুরবানীর গোশত ও রক্ত ধর্তব্য নয়।
৩. অনেক মানুষের নিকট গোশতই ধর্তব্য; অন্য কিছুই নয়।
৪. আল্লাহর নিকট মানুষের চেহারা ও ধন-সম্পদের কোনো গুরুত্ব নেই, গুরুত্ব শুধু ‘আমলেরই।
৫. ‘আমলের মূল স্তম্ভ ইখলাস যা ব্যতীত ‘আমলের ফলাফল শুন্য।
৬. আল্লাহর নিকট ‘আমলের মানদ- নির্ণয় হয় মানুষের তাক্বওয়া অনুযায়ী।
৭. কুরবানী প্রদানকারী ব্যক্তির কুরবানী কবূল হওয়ার জন্যে নিয়্যাতটাই যথেষ্ট।
৮. আল্লাহভীতি না থাকলে অর্থাৎ- কুরবানী খালেস নিয়তে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা না হলে তা কবুল হয় না।
৯. আল্লাহভীতি বা তাক্বওয়া শুধু কুরবানী কবুল হওয়ার পূর্ব শর্ত নয়, যে কোন ‘ইবাদত কবুল হওয়া বা আদর্শ মুসলিম তথা প্রকৃত মানুষ হওয়ারও পূর্বশর্ত।
১০. তাক্বওয়ার জীবন্ত প্রতীক ছিলেন আল্লাহর নাবী-রাসূলগণ। যুগে যুগে তাঁদেরকে অনুসরণ করে একদল লোক প্রকৃত মু’মিন বা আদর্শ মানুষে পরিণত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
১১. কুরবানীর ক্ষেত্রে তাক্বওয়ার সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ রেখেছেন মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইব্রা-হীম (‘আলাইহিস্ সালাম), ইসমা‘ঈল (‘আলাইহিস্ সালাম) এবং হাজেরা (‘আলাইহিস্ সালাম)।
১২. প্রাক ইসলামী যুগে মানুষ কুরবানী করার পর কুরবানীর পশুর গোশ্ত আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্যে নিবেদন করার জন্য কা‘বা ঘরের সামনে রেখে দিত, পশুর রক্ত কা‘বার দেয়ালে লেপটে দিত। সূরা আল হাজ্জ-এর পূর্বোদ্ধৃত ৩৭ নং আয়াতে এ কুপ্রথার মূলোৎপাটন করে সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়া হয়েছে-
﴿لَنْ يَنَالَ اللهَ لُحُوْمُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ كَذَلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوْا اللهَ عَلٰى مَا هَدَاكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِيْنَ﴾
“কুরবানীর পশুর রক্ত-মাংসের কোন প্রয়োজন আল্লাহর নেই, তিনি যা চান তাহলো কুরবানীকারীর তাক্বওয়া, আল্লাহর প্রতি একান্ত আনুগত্য ও আল্লাহর প্রতি মু’মিন-চিত্তের একাগ্রতা।”
১৩. একথা সুবিদিত যে, লোভ, মোহ, স্বার্থপরতা ও কুপ্রবৃত্তির মধ্যে কখনো তাক্বওয়া বা আল্লাহ-সচেতনতা সৃষ্টি হয় না। অতএব, কুরবানী আমাদেরকে এসব মানবিক দুবর্লতার ঊর্ধ্বে ওঠার শিক্ষা দেয়।
১৪. হাজ্জ উপলক্ষে যেমন একমাত্র মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে পার্থিব সকল কিছু বিসর্জন দিয়ে মক্কায় সমবেত হতে হয়, কুরবানীও তেমনি শুধু মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে ইব্রা-হীম (‘আলাইহিস্ সালাম) তাঁর প্রাণাধিক পুত্রকে কুরবানী করতে উদ্যত হয়ে যে চরম আত্মত্যাগের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন সে মহান স্মৃতিকে স্মরণ করে প্রতি বছর পশু কুরবানী করে মু’মিনদেরকে মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগের পরীক্ষা দিতে হয়।
উপসংহার : পবিত্র হাজ্জ, ঈদ-উল-আযহা ও কুরবানী প্রতি বছর আমাদের জন্য বহন করে আনে অপরিসীম আত্মত্যাগের সুমহান বার্তা। এ উপলক্ষে আমরা আত্মত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের মাধ্যমে একাধারে মহান স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বজনীন মানবিক মূল্যবোধ ও কল্যাণ-চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হতে পারি। এর প্রত্যেকটিই গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ‘ইবাদত।
একমাত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই এর লক্ষ্য। কোনরূপ প্রদর্শনেচ্ছা, পার্থিব ফায়দা হাসিলের মনোভাব যেন এর মধ্যে স্থান লাভ করতে না পারে। ‘ইন্না সালাতি ওয়ানুসুকি ওয়া মাহ্ইয়া ইয়া ওয়ামামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’- অর্থাৎ- আমার সালাত, কুরবানী তথা সকল ‘ইবাদত একমাত্র মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যেই নিবেদিত হোক! আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে এরূপ গুরুত্বপূর্ণ ‘ইবাদত পালন করার তাওফীক্ব দান করুন -আমীন।
[১]. ২২ নং সূরাহ্ আল হাজ্জ, আয়াত- ৩৭।
[২]. তাফসীর ইবনু কাসীর।
[৩].
সহীহ মুসলিম- হাদীস নং- ৬৭০৮। শেষাংশটুকু ইমাম তিরমিযী ও ইবনু মাজাহ্
বর্ণনা করেছেন। তবে হাদীসটি য‘ঈফ। জামি‘ তিরমিযী- হাঃ ১৪৯৩।
[৪]. ২ নং সূরাহ্ আল বাক্বার্হা, আয়াত- ২৭।
[৫]. ৩৭ নং সূরাহ্ আস্ সা-ফ্ফা-ত, আয়াত- ১০২।
[৬]. ২২ নং সূরাহ্ আল হাজ্জ, আয়াত- ৩৪।
[৭]. ১০৮ নং সূরাহ্ আল কাওসার, আয়াত- ২।
[৮]. ৬ নং সূরাহ্ আল আন‘আম, আয়াত- ১৬২।
[৯]. জামি‘ আত্ তিরমিযী, মুসনাদ আহমাদ।
[১০]. সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম।
[১১]. সহীহুল বুখারী।
[১২]. মুসনাদ আহমাদ।
ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:17:45
সূর্যাস্ত : 5:11:51
আপনার মন্তব্য1