আল কুরআনুল হাকীম
“মাহে রামাযানের পরে কোন পথে?”
শাইখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ খান মাদানী
আল্লাহ তা‘আলার বাণী :
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ
﴿فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَمَنْ تَابَ مَعَكَ وَلَا تَطْغَوْا إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ - وَلَا تَرْكَنُوْا إِلَى الَّذِيْنَ ظَلَمُوْا فَتَمَسَّكُمُ النَّارُ وَمَا لَكُم مِّنْ دُوْنِ اللهِ مِنْ أَوْلِيَاء ثُمَّ لَا تُنصَرُوْنَ وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيْ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِّنَ اللَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّـيِّئَاتِ ذٰلِكَ ذِكْرَى لِلذَّاكِرِيْنَ - وَاصْبِرْ فَإِنَّ اللهَ لاَ يُضِيْعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِيْنَ﴾
সরল অনুবাদ : “অতএব তুমি এবং তোমার সাথে যারা তাওবাহ্ করেছে সবাই (দীনের উপর) সুদৃঢ় হয়ে থাক আল্লাহ যেভাবে তোমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, আর সীমালঙ্ঘন করো না। তোমরা যা কিছু করো তিনি তা ভালভাবেই দেখেন। তোমরা পাপাচারী যালিমদের প্রতি ঝুঁকে পড়ো না, তাহলে আগুন তোমাদের স্পর্শ করবে, আর তখন আল্লাহ ছাড়া কেউ তোমাদের অভিভাবক থাকবে না এবং তোমাদেরকে সাহায্যও করা হবে না। আর দিনের দুই প্রান্তে এবং রাতের কিছু অংশে সালাত কায়েম করো, নিশ্চয়ই পুণ্য কাজ পাপকে দূর করে দেয়, যারা (আল্লাহকে) স্মরণ করে এটা তাদের জন্য উপদেশস্বরূপ। ধৈর্য ধারণ করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না।”[১]
আয়াতসমূহ অবতরণের প্রেক্ষাপট : আলোচ্য আয়াতসমূহ সূরা হুদ-এর অন্তর্গত, সূরা হুদ মাক্কী সূরা। অতএব আলোচ্য আয়াতসমূহ ইসলামের প্রাথমিক যুগে সালাতের সময় এবং ইসলামের উপর অটল থেকে প্রতিকূল অবস্থায় ধৈর্য ধারণের নির্দেশ নিয়ে অবতীর্ণ হয়।
আয়াতসমূহের আলোচ্য বিষয় : আলোচ্য আয়াতসমূহে সর্বমোট পাঁচটি বিষয়ে আলোচনা স্থান পেয়েছে-
(১) সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ পালনে অটল থাকা।
(২) সীমালঙ্ঘন, পাপাচার, যুলম ও নির্যাতনে লিপ্ত না হওয়া।
(৩) যথা সময়ে সালাত কায়েম করা।
(৪) সৎ কর্মের মাধ্যমে পাপ কর্ম মোচন হয়ে যায়।
(৫) সত্যের উপর ধৈর্য ধারণ করা এবং ধৈর্যের প্রতিদান।
আয়াতসমূহের সংক্ষিপ্ত তাফসীর :
﴿فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَمَنْ تَابَ مَعَكَ وَلَا تَطْغَوْا إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ﴾
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা রাসূল ﷺ এবং মু’মিনদের মহান আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী পূর্ণ ইসলামের উপর সর্বদায় অটল থাকার জন্য নির্দেশ প্রদান করছেন। কারণ ইসলাম কোন নির্দিষ্ট মাস বা বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং জীবনের সর্ব মুহূর্তে ও সর্বক্ষেত্রেই ইসলাম মেনে চলতে হবে। সাথে সাথেই আল্লাহ তা‘আলা আরেক নির্দেশ জারি করছেন যে, তোমরা সীমালঙ্ঘন করো না, অর্থাৎ- শরী‘আত মানার ক্ষেত্রেও তা ইসলামী সীমারেখার মধ্যে থেকে মেনে চলতে হবে, মনগড়া বা খেয়াল খুশী অনুযায়ী মানলে চলবে না। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿وَلَا تَرْكَنُوْا إِلَى الَّذِيْنَ ظَلَمُوْا فَتَمَسَّكُمُ النَّارُ وَمَا لَكُم مِّن دُوْنِ اللهِ مِنْ أَوْلِيَاء ثُمَّ لَا تُنصَرُوْنَ﴾
আল্লাহ তা‘আলা পূর্বের আয়াতে ইসলামের উপর অটল থাকার নির্দেশ দিয়ে এ আয়াতে ইসলাম হতে দূরে সরে পড়ার পথকে বন্ধ করে দেন এবং তার পরিণতিও বর্ণনা করে দেন। পাপাচারী ও অত্যাচারীদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া এবং তাদের সংস্পর্শে যাওয়া তাদের মতো অসৎকর্মে লিপ্ত হওয়ার শামিল, তাই আল্লাহ তা‘আলা এটা নিষিদ্ধ করেছেন, আর তাদের সাথে সম্পর্ক রাখার মাধ্যমে অসৎ কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়লে অবশ্যই ‘আযাব ভোগ করতে হবে এবং আল্লাহ তা‘আলার অভিভাবকত্ব ও সাহায্য সহযোগিতা হারাতে হবে। তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِّنَ اللَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّـيِّئَاتِ ذٰلِكَ ذِكْرَى لِلذَّاكِرِيْنَ﴾
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের মধ্যে চার ওয়াক্তের সময়কাল এর আলোচনা করেছেন। দিনের দুই প্রান্তে অর্থাৎ- সকাল ও বিকালে ফজর ও 'আসর সালাত আর রাতের কিছু অংশে অর্থাৎ- মাগরিব ও ‘ইশার সালাত। অন্যত্র (সূরা বানী ইসরা-ঈলে) যোহরের সালাতের সময় উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবেই আল্লাহ তা‘আলা সালাতের সময়ের ইঙ্গিতসূচক আলোচনা করেছেন, আর কুরআনের মূল ভাষ্যকার রাসূলুল্লাহ ﷺ স্বীয় হাদীসে সবিস্তারে আলোকপাত করেছেন। অতএব ঐ নির্ধারিত সময়ে মহানাবী ﷺ-এর পদ্ধতি অনুযায়ী সালাত আদায় করার নামই হলো ইকামাতুস্ সালাত।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “সৎ কর্মসমূহ অসৎকর্ম বা পাপকে দূর করে দেয়।” এটা সাধারণত দুই প্রকার- এক. সকল প্রকার অসৎ কর্ম বা পাপকে দূর করে দেয় (অর্থাৎ- ছোট বড় সব পাপ) যেমন ইসলাম গ্রহণ পূর্ববর্তী সকল পাপ মোচনের মতো সৎকর্ম। দুই. শুধুমাত্র ছোট পাপকর্মকে দূর করে দেয় যেমন পাঁচ ওয়াক্ত র্ফয সালাত ও ওযূ ইত্যাদি। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿وَاصْبِرْ فَإِنَّ اللهَ لاَ يُضِيْعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِيْنَ﴾
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সবর বা ধৈর্য ধারণের কথা বলেন। মূলতঃ রামাযানের অন্যতম শিক্ষা ও ফসল হলো ধৈর্য, এজন্যই বলা হয় সাওম হলো ধৈর্যের অর্ধেক। ধৈর্য সাধারণত তিন প্রকার। (১) মহান আল্লাহর আনুগত্যে অটল থেকে ধৈর্য ধারণ, (২) মহান আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ। (৩) ভাগ্যের মন্দ ও ব্যথাদায়ক বিষয়ের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর উপর আস্থা রেখে ধৈর্য ধারণ।
পবিত্র রামাযান মাসে যেমন মহান আল্লাহর আনুগত্যে অটল থেকে এবং তার অবাধ্যতা হতে বিরত থেকে ধৈর্য ধারণ করেছি ঠিক তেমনি বছরের বাকী মাসগুলোতেও প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তির ধৈর্য ধারণ করা কর্তব্য। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের তাওফীক দান করুন -আমীন।
মাহে রামাযানের পরে মুসলিম ব্যক্তির অবস্থান : দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, আমরা শুধু রামাযান মাস আসলেই মহান আল্লাহকে চিনি, আর রামাযান চলে গেলে মহান আল্লাহকে ভুলে যাই। রামাযান আসলে সালাত পড়ি, রামাযান চলে গেলে সালাত ছেড়ে দিই। রামাযান আসলে অন্যায় অশ্লীলতা হতে বিরত থাকি, রামাযান চলে গেলে অন্যায় অশ্লীল অপকর্মে লিপ্ত হয়ে যাই। রামাযান আসলে কুর’আন হাতে নিই, রামাযান চলে গেলে কুরআনের কথা ভুলে যাই। এরূপ কী কোন মুসলমানের জন্য শোভা পায়? না, না, কখনও না! মুসলিম সর্বদায় মুসলিম হিসেবে থাকবে। মুসলিম মু’মিন ব্যক্তি একসময় মহান আল্লাহর আনুগত্যশীল হবে, আরেক সময় অবাধ্য হবে এরূপ কখনও হতে পারে না; বরং এ অবস্থা হলো মুনাফিক কপটের, যে একবার মহান আল্লাহর মান্য হবে আবার পরক্ষণেই অমান্য হবে। মহান আল্লাহর নির্দেশ হলো তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের মুহূর্ত হতে জীবনের শেষ নিঃশ্বাষ ত্যাগ করা পর্যন্ত তাঁর আনুগত্যে রত থাকবে। এ মর্মে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتّٰى يَأْتِيَكَ الْيَقِيْنُ﴾
“নিশ্চিত মৃত্যু আসা পর্যন্ত তোমার রবের ‘ইবাদতে রত থাকো।”[২]
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন :
্রقُلْ : آمَنْتُ بِاللهِ، ثُمَّ فَاسْتَقِمْগ্ধ.
“বলো : মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি অতঃপর সে ঈমানে অটল থাকো।”[৩]
অতএব মুসলিম ব্যক্তি এক ‘ইবাদত হতে অবসর হলে ‘ইবাদত বন্ধ করে দিবে তা নয়; বরং এক ‘ইবাদত হতে অবসর হলে আরেক ‘ইবাদতে লিপ্ত হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿فَإِذَا فَرَغْتَ فَانصَبْ - وَإِلَى رَبِّكَ فَارْغَبْ﴾
“অতএব তুমি যখনই অবসর হবে তখনই (অন্য ‘ইবাদতে) লেগে যাও এবং তোমার রবের প্রতি গভীরভাবে মনোযোগী হও।”[৪]
সুতরাং রামাযান মাসের সাওম শেষ হলেও ইসলামের রোযা বা সিয়াম নামক ‘ইবাদত শেষ হয়ে যায় না। রামাযান মাস ছাড়া বছরের বাকী দিনগুলোতে বহু ধরনের সিয়াম বা রোযা পালন করার সুযোগ রয়েছে যা এখানে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ রামাযানের পরই শাওয়াল মাসের ছয়টি সাওম। প্রতি মাসে তিনটি করে আইয়ামে বিযের সাওম, আরাফা দিবসের সাওম, আশুরার সাওম, যিলহাজ্জ মাসের প্রথম নয় দিনের রোযা, প্রতি সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা ইত্যাদি। এ রোযাসমূহ বছরের অন্যান্য দিনগুলোতে আমরা রাখতে পারি।
রামাযানের কিয়াম বা তারাবীহ শেষ হয়ে গেলেও অন্য রাত্রিগুলোর কিয়াম বা তাহাজ্জুদ শেষ হয় না, সালাতুয যুহা বা চাস্তের সালাত- ইত্যাদি সালাতসমূহ রামাযান মাস চলে গেলেও তা প্রতিটি মাস বা দিনে আদায় করা যায়।
অনুরূপভাবে রামাযানে কুর’আন খতম শেষ হয়ে গেলেও কুরআন পাঠ ও গবেষণার সময় শেষ হয়ে যায়নি কারণ তা বছরের প্রতিদিনের কর্মসূচী হওয়া উচিত। একইভাবে দান খয়রাত এবং অন্যায় অশ্লীলতা, সুদ, ঘুষ ইত্যাদি বর্জন সবকিছু রামাযানের পরেও প্রতিদিন মুসলিম ব্যক্তির কর্মসূচীর মধ্যে থাকা আবশ্যক।
উপসংহার : এ দারসের উপসংহারে আমরা বলতে পারি যে, মুসলিম ব্যক্তির ‘ইবাদত কোন সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তার পূর্ণ জীবনটাই আল্লাহ তা‘আলার ‘ইবাদতের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করবে। শুধু রামাযান মাসে সিয়াম, কিয়াম তিলাওয়াত ও দান সাদাক্বায় ব্যস্ত থেকে বাকী এগারটি মাসে যেমন খুশী তেমন চললে তার পরিণতি ভয়াবহ হওয়াই স্বাভাবিক, এমনকি রামাযানের সকল ‘ইবাদতও বাতিল হয়ে যাওয়াটাও অসম্ভব কিছু নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿وَلَا تَكُوْنُوْا كَالَّتِيْ نَقَضَتْ غَزْلَهَا مِن بَعْدِ قُوَّةٍ أَنكَاثًا﴾
“তোমরা এমন নারীর মত হয়ো না যে তার সুতাগুলোকে শক্ত করে পাকানোর পর নিজেই তার পাক খুলে টুকরো টুকরো করে দেয়।”[৫]
সুতরাং প্রকৃত মুসলিম ব্যক্তি রামাযান মাসে অন্য মাসের তুলনায় বেশী ‘ইবাদত করতে পারে কিন্তু অন্য মাসে কখনও মহান আল্লাহকে ভুলে যেতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের আমরণ তাঁর পূর্ণ আনুগত্যের উপর থাকার তাওফীক্ব দান করুন -আমীন। ###
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ
﴿فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَمَنْ تَابَ مَعَكَ وَلَا تَطْغَوْا إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ - وَلَا تَرْكَنُوْا إِلَى الَّذِيْنَ ظَلَمُوْا فَتَمَسَّكُمُ النَّارُ وَمَا لَكُم مِّنْ دُوْنِ اللهِ مِنْ أَوْلِيَاء ثُمَّ لَا تُنصَرُوْنَ وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيْ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِّنَ اللَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّـيِّئَاتِ ذٰلِكَ ذِكْرَى لِلذَّاكِرِيْنَ - وَاصْبِرْ فَإِنَّ اللهَ لاَ يُضِيْعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِيْنَ﴾
সরল অনুবাদ : “অতএব তুমি এবং তোমার সাথে যারা তাওবাহ্ করেছে সবাই (দীনের উপর) সুদৃঢ় হয়ে থাক আল্লাহ যেভাবে তোমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, আর সীমালঙ্ঘন করো না। তোমরা যা কিছু করো তিনি তা ভালভাবেই দেখেন। তোমরা পাপাচারী যালিমদের প্রতি ঝুঁকে পড়ো না, তাহলে আগুন তোমাদের স্পর্শ করবে, আর তখন আল্লাহ ছাড়া কেউ তোমাদের অভিভাবক থাকবে না এবং তোমাদেরকে সাহায্যও করা হবে না। আর দিনের দুই প্রান্তে এবং রাতের কিছু অংশে সালাত কায়েম করো, নিশ্চয়ই পুণ্য কাজ পাপকে দূর করে দেয়, যারা (আল্লাহকে) স্মরণ করে এটা তাদের জন্য উপদেশস্বরূপ। ধৈর্য ধারণ করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না।”[১]
আয়াতসমূহ অবতরণের প্রেক্ষাপট : আলোচ্য আয়াতসমূহ সূরা হুদ-এর অন্তর্গত, সূরা হুদ মাক্কী সূরা। অতএব আলোচ্য আয়াতসমূহ ইসলামের প্রাথমিক যুগে সালাতের সময় এবং ইসলামের উপর অটল থেকে প্রতিকূল অবস্থায় ধৈর্য ধারণের নির্দেশ নিয়ে অবতীর্ণ হয়।
আয়াতসমূহের আলোচ্য বিষয় : আলোচ্য আয়াতসমূহে সর্বমোট পাঁচটি বিষয়ে আলোচনা স্থান পেয়েছে-
(১) সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ পালনে অটল থাকা।
(২) সীমালঙ্ঘন, পাপাচার, যুলম ও নির্যাতনে লিপ্ত না হওয়া।
(৩) যথা সময়ে সালাত কায়েম করা।
(৪) সৎ কর্মের মাধ্যমে পাপ কর্ম মোচন হয়ে যায়।
(৫) সত্যের উপর ধৈর্য ধারণ করা এবং ধৈর্যের প্রতিদান।
আয়াতসমূহের সংক্ষিপ্ত তাফসীর :
﴿فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَمَنْ تَابَ مَعَكَ وَلَا تَطْغَوْا إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ﴾
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা রাসূল ﷺ এবং মু’মিনদের মহান আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী পূর্ণ ইসলামের উপর সর্বদায় অটল থাকার জন্য নির্দেশ প্রদান করছেন। কারণ ইসলাম কোন নির্দিষ্ট মাস বা বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং জীবনের সর্ব মুহূর্তে ও সর্বক্ষেত্রেই ইসলাম মেনে চলতে হবে। সাথে সাথেই আল্লাহ তা‘আলা আরেক নির্দেশ জারি করছেন যে, তোমরা সীমালঙ্ঘন করো না, অর্থাৎ- শরী‘আত মানার ক্ষেত্রেও তা ইসলামী সীমারেখার মধ্যে থেকে মেনে চলতে হবে, মনগড়া বা খেয়াল খুশী অনুযায়ী মানলে চলবে না। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿وَلَا تَرْكَنُوْا إِلَى الَّذِيْنَ ظَلَمُوْا فَتَمَسَّكُمُ النَّارُ وَمَا لَكُم مِّن دُوْنِ اللهِ مِنْ أَوْلِيَاء ثُمَّ لَا تُنصَرُوْنَ﴾
আল্লাহ তা‘আলা পূর্বের আয়াতে ইসলামের উপর অটল থাকার নির্দেশ দিয়ে এ আয়াতে ইসলাম হতে দূরে সরে পড়ার পথকে বন্ধ করে দেন এবং তার পরিণতিও বর্ণনা করে দেন। পাপাচারী ও অত্যাচারীদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া এবং তাদের সংস্পর্শে যাওয়া তাদের মতো অসৎকর্মে লিপ্ত হওয়ার শামিল, তাই আল্লাহ তা‘আলা এটা নিষিদ্ধ করেছেন, আর তাদের সাথে সম্পর্ক রাখার মাধ্যমে অসৎ কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়লে অবশ্যই ‘আযাব ভোগ করতে হবে এবং আল্লাহ তা‘আলার অভিভাবকত্ব ও সাহায্য সহযোগিতা হারাতে হবে। তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِّنَ اللَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّـيِّئَاتِ ذٰلِكَ ذِكْرَى لِلذَّاكِرِيْنَ﴾
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের মধ্যে চার ওয়াক্তের সময়কাল এর আলোচনা করেছেন। দিনের দুই প্রান্তে অর্থাৎ- সকাল ও বিকালে ফজর ও 'আসর সালাত আর রাতের কিছু অংশে অর্থাৎ- মাগরিব ও ‘ইশার সালাত। অন্যত্র (সূরা বানী ইসরা-ঈলে) যোহরের সালাতের সময় উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবেই আল্লাহ তা‘আলা সালাতের সময়ের ইঙ্গিতসূচক আলোচনা করেছেন, আর কুরআনের মূল ভাষ্যকার রাসূলুল্লাহ ﷺ স্বীয় হাদীসে সবিস্তারে আলোকপাত করেছেন। অতএব ঐ নির্ধারিত সময়ে মহানাবী ﷺ-এর পদ্ধতি অনুযায়ী সালাত আদায় করার নামই হলো ইকামাতুস্ সালাত।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “সৎ কর্মসমূহ অসৎকর্ম বা পাপকে দূর করে দেয়।” এটা সাধারণত দুই প্রকার- এক. সকল প্রকার অসৎ কর্ম বা পাপকে দূর করে দেয় (অর্থাৎ- ছোট বড় সব পাপ) যেমন ইসলাম গ্রহণ পূর্ববর্তী সকল পাপ মোচনের মতো সৎকর্ম। দুই. শুধুমাত্র ছোট পাপকর্মকে দূর করে দেয় যেমন পাঁচ ওয়াক্ত র্ফয সালাত ও ওযূ ইত্যাদি। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿وَاصْبِرْ فَإِنَّ اللهَ لاَ يُضِيْعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِيْنَ﴾
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সবর বা ধৈর্য ধারণের কথা বলেন। মূলতঃ রামাযানের অন্যতম শিক্ষা ও ফসল হলো ধৈর্য, এজন্যই বলা হয় সাওম হলো ধৈর্যের অর্ধেক। ধৈর্য সাধারণত তিন প্রকার। (১) মহান আল্লাহর আনুগত্যে অটল থেকে ধৈর্য ধারণ, (২) মহান আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ। (৩) ভাগ্যের মন্দ ও ব্যথাদায়ক বিষয়ের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর উপর আস্থা রেখে ধৈর্য ধারণ।
পবিত্র রামাযান মাসে যেমন মহান আল্লাহর আনুগত্যে অটল থেকে এবং তার অবাধ্যতা হতে বিরত থেকে ধৈর্য ধারণ করেছি ঠিক তেমনি বছরের বাকী মাসগুলোতেও প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তির ধৈর্য ধারণ করা কর্তব্য। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের তাওফীক দান করুন -আমীন।
মাহে রামাযানের পরে মুসলিম ব্যক্তির অবস্থান : দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, আমরা শুধু রামাযান মাস আসলেই মহান আল্লাহকে চিনি, আর রামাযান চলে গেলে মহান আল্লাহকে ভুলে যাই। রামাযান আসলে সালাত পড়ি, রামাযান চলে গেলে সালাত ছেড়ে দিই। রামাযান আসলে অন্যায় অশ্লীলতা হতে বিরত থাকি, রামাযান চলে গেলে অন্যায় অশ্লীল অপকর্মে লিপ্ত হয়ে যাই। রামাযান আসলে কুর’আন হাতে নিই, রামাযান চলে গেলে কুরআনের কথা ভুলে যাই। এরূপ কী কোন মুসলমানের জন্য শোভা পায়? না, না, কখনও না! মুসলিম সর্বদায় মুসলিম হিসেবে থাকবে। মুসলিম মু’মিন ব্যক্তি একসময় মহান আল্লাহর আনুগত্যশীল হবে, আরেক সময় অবাধ্য হবে এরূপ কখনও হতে পারে না; বরং এ অবস্থা হলো মুনাফিক কপটের, যে একবার মহান আল্লাহর মান্য হবে আবার পরক্ষণেই অমান্য হবে। মহান আল্লাহর নির্দেশ হলো তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের মুহূর্ত হতে জীবনের শেষ নিঃশ্বাষ ত্যাগ করা পর্যন্ত তাঁর আনুগত্যে রত থাকবে। এ মর্মে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتّٰى يَأْتِيَكَ الْيَقِيْنُ﴾
“নিশ্চিত মৃত্যু আসা পর্যন্ত তোমার রবের ‘ইবাদতে রত থাকো।”[২]
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন :
্রقُلْ : آمَنْتُ بِاللهِ، ثُمَّ فَاسْتَقِمْগ্ধ.
“বলো : মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি অতঃপর সে ঈমানে অটল থাকো।”[৩]
অতএব মুসলিম ব্যক্তি এক ‘ইবাদত হতে অবসর হলে ‘ইবাদত বন্ধ করে দিবে তা নয়; বরং এক ‘ইবাদত হতে অবসর হলে আরেক ‘ইবাদতে লিপ্ত হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿فَإِذَا فَرَغْتَ فَانصَبْ - وَإِلَى رَبِّكَ فَارْغَبْ﴾
“অতএব তুমি যখনই অবসর হবে তখনই (অন্য ‘ইবাদতে) লেগে যাও এবং তোমার রবের প্রতি গভীরভাবে মনোযোগী হও।”[৪]
সুতরাং রামাযান মাসের সাওম শেষ হলেও ইসলামের রোযা বা সিয়াম নামক ‘ইবাদত শেষ হয়ে যায় না। রামাযান মাস ছাড়া বছরের বাকী দিনগুলোতে বহু ধরনের সিয়াম বা রোযা পালন করার সুযোগ রয়েছে যা এখানে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ রামাযানের পরই শাওয়াল মাসের ছয়টি সাওম। প্রতি মাসে তিনটি করে আইয়ামে বিযের সাওম, আরাফা দিবসের সাওম, আশুরার সাওম, যিলহাজ্জ মাসের প্রথম নয় দিনের রোযা, প্রতি সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা ইত্যাদি। এ রোযাসমূহ বছরের অন্যান্য দিনগুলোতে আমরা রাখতে পারি।
রামাযানের কিয়াম বা তারাবীহ শেষ হয়ে গেলেও অন্য রাত্রিগুলোর কিয়াম বা তাহাজ্জুদ শেষ হয় না, সালাতুয যুহা বা চাস্তের সালাত- ইত্যাদি সালাতসমূহ রামাযান মাস চলে গেলেও তা প্রতিটি মাস বা দিনে আদায় করা যায়।
অনুরূপভাবে রামাযানে কুর’আন খতম শেষ হয়ে গেলেও কুরআন পাঠ ও গবেষণার সময় শেষ হয়ে যায়নি কারণ তা বছরের প্রতিদিনের কর্মসূচী হওয়া উচিত। একইভাবে দান খয়রাত এবং অন্যায় অশ্লীলতা, সুদ, ঘুষ ইত্যাদি বর্জন সবকিছু রামাযানের পরেও প্রতিদিন মুসলিম ব্যক্তির কর্মসূচীর মধ্যে থাকা আবশ্যক।
উপসংহার : এ দারসের উপসংহারে আমরা বলতে পারি যে, মুসলিম ব্যক্তির ‘ইবাদত কোন সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তার পূর্ণ জীবনটাই আল্লাহ তা‘আলার ‘ইবাদতের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করবে। শুধু রামাযান মাসে সিয়াম, কিয়াম তিলাওয়াত ও দান সাদাক্বায় ব্যস্ত থেকে বাকী এগারটি মাসে যেমন খুশী তেমন চললে তার পরিণতি ভয়াবহ হওয়াই স্বাভাবিক, এমনকি রামাযানের সকল ‘ইবাদতও বাতিল হয়ে যাওয়াটাও অসম্ভব কিছু নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿وَلَا تَكُوْنُوْا كَالَّتِيْ نَقَضَتْ غَزْلَهَا مِن بَعْدِ قُوَّةٍ أَنكَاثًا﴾
“তোমরা এমন নারীর মত হয়ো না যে তার সুতাগুলোকে শক্ত করে পাকানোর পর নিজেই তার পাক খুলে টুকরো টুকরো করে দেয়।”[৫]
সুতরাং প্রকৃত মুসলিম ব্যক্তি রামাযান মাসে অন্য মাসের তুলনায় বেশী ‘ইবাদত করতে পারে কিন্তু অন্য মাসে কখনও মহান আল্লাহকে ভুলে যেতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের আমরণ তাঁর পূর্ণ আনুগত্যের উপর থাকার তাওফীক্ব দান করুন -আমীন। ###
[১] সূরা হুদ : ১১২-১১৫।
[২] সূরা আল হিজর : ৯৯।
[৩] সহীহ মুসলিম- হাঃ ৬২/৩৮।
[৪] সূরা আলাম নাশরাহ : ৭ ও ৮।
[৫] সূরা আন্ নাহ্ল : ৯২।
ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:31:55
সূর্যাস্ত : 5:13:27
আপনার মন্তব্য1