সাময়িক প্রসঙ্গ
সিয়ামে রামাযান ও তাক্বওয়ার অনুশীলন
শাইখ মুহাম্মাদ হারুন হুসাইন
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلٰى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ﴾
সরল অর্থানুবাদ : “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হলো, যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর করা হয়েছিল- যাতে তোমরা  সংযমশীল হতে পারো।”[১]
দারসের প্রতিপাদ্য বিষয় : আলোচ্য আয়াতে কারীমাতে সিয়াম ফরয-একথা অকাট্যভাবে বিধৃত হয়েছে। এটি মানবসভ্যতার কল্যাণে প্রদত্ত মহান আল্লাহর আমোঘ বিধানের অন্যতম। এ সিয়াম বিগত সকল জাতির মধ্যে বিদ্যমান ছিল। আর এ গুরুত্বপূর্ণ ‘ইবাদত-এর মূখ্য উদ্দেশ্য হলো মানুষকে সংযমী, আল্লাহভীরু ও প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।
সিয়াম কাকে বলে?
الصِّيَامُ বা الصوم অর্থ বিরত থাকা। কোন বিষয় বা বস্তু হতে নিজেকে আটকে রাখা ইত্যাদি। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খানা-পিনা, স্ত্রী সহবাস ও সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয় হতে বিরত থাকার নাম সিয়াম।[২]
কখন সিয়ামে রামাযান র্ফয হয়?
এ প্রশ্ন দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- আমাদের নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর মাধ্যমে এ উম্মাত-এর উপর কখন থেকে সিয়াম ফরয হয়? বলিষ্ট দলীল-প্রমাণ দ্বারা একথা সন্দেহতীতভাবে প্রমাণিত যে, প্রথম হিজরীতে মুর্হারাম মাসের ১০ম তারিখ আশুরার সিয়াম ফরয হওয়ার মধ্য দিয়ে এ উম্মাতের উপর সিয়াম ফরযের সূচনা হয়। অতঃপর ২য় হিজরীর শা‘বান মাসে দারসে উল্লিখিত আয়াত অবতরণ ও তৎপরবর্তী আয়াত দ্বারা রামাযানের সিয়াম ফরয হিসাবে স্থির হয়। আর আশুরার সিয়াম নফল হিসেবে আখ্যা পায়।[৩]
মহান আল্লাহর বাণী : ﴿كَمَا كُتِبَ عَلٰى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ﴾
অর্থাৎ- “যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর” আয়াতাংশের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য দু’টি। (এক) সিয়াম এমন একটি ‘ইবাদত যা বিগত সকল জাতির উপর ফরয ছিল। কেননা, সিয়ামের প্রয়োজনীয়তা, কার্যকারিতা ও উদ্দেশ্য বিবেচনায় সকল যুগের সকল মানুষের জন্য আবশ্যকীয় মৌলিক ‘ইবাদত। তাই মহান আল্লাহ এ বিধান সর্বকালের জন্য জারি রেখেছেন। (দুই) আর পূর্ববর্তীদের উপর ফরয ছিল একথা স্মরণ করিয়ে প্রিয় নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রিয় উম্মাতকে উৎসাহিত করা। যাতে তারা একাগ্রচিত্তে সিয়াম পালন করতে পারে এবং নেকীর প্রতিযোগীতায় জোরালোভাবে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়।[৪]
তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি কি?
التقوى শব্দটি الوقاية শব্দমূল থেকে বুৎপত্তিসিদ্ধ। অর্থ বেচে থাকা, সাবধানতা অবলম্বন করা ইত্যাদি। সহজ অর্থে ভয়-ভীতির স্থানসমূহ ও তার উপকরণ হতে দূরে অবস্থান করাকে তাক্বওয়া বলা হয়। সাহাবী আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হু) জিজ্ঞাসিত হয়ে বলেছিলেন, কাঁটাযুক্ত পথ অতিসংযতভাবে জামা-কাপড় গুটিয়ে একান্ত সাবধানতার সাথে অতিক্রম করা যেমন, ঠিক তাক্বওয়া তেমনি বিষয়।[৫]
তাক্বওয়ার উদ্দেশ্য : মহান আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনের মাধ্যমে তাঁর আযাব ও গযব থেকে বেঁচে থাকা। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তাঁর আদেশসমূহ যথাসাধ্য পালন করা এবং তাঁর নিকটই এর বিনিময় কামনা করা। সাথে সাথে ‘আযাবের ভয়ে তাঁর নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ হতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। কোন অবস্থাতেই কোনরূপ নাফরমানী বা অবাধ্যতার কাজে নিজেকে না জড়ানো। এভাবে সর্তক জীবন-যাপনের মাধ্যমে একজন মানুষ প্রকৃত মানুষ হওয়ার সুযোগ পায়। যে মানুষ সমাজের জন্য বুঝা নয়; বরং রহমত হয়। অগত্যা কারো উপকারে না আসলেও কদাচিত কারো কোন অপকার বা ক্ষতি করে না। হায়! এমন মানুষ হতে পারব কি?
সিয়াম ও তাক্বওয়া : আলোচ্য আয়াতে মহান আল্লাহ সিয়াম-এর অন্যতম উদ্দেশ্য হিসাবে একথা জানালেন যে, ﴿لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ﴾ “যাতে তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বন করতে পারো।” তাই একথা নির্দিধায় বলা যায়- তাক্বওয়ার যথাযথ অনুশীলন সিয়ামের মাধ্যমেই সম্ভব। ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন, সিয়াম একটি ঢাল বা রক্ষাকবচ। কেননা, এটা জৈবিক চাহিদাকে ধ্বংস করে নাফরমানী থেকে বাঁচায়।[৬]
খলীফা ‘উমার ইবনু ‘আবদুল ‘আযীয (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন : দিনে সিয়াম আর রাতে তারাবীহ আদায়ের নাম আল্লাহর তাক্বওয়া নয়। কিংবা কেবল দু’টির সমন্বয়ের নামও নয়; বরং আল্লাহর তাক্বওয়া হচ্ছে- আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তা থেকে বিরত থাকা এবং যা ফরয করেছেন, তা পালন করা।[৭]
এ কারণে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লাম) বলেন :
্রمَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّوْرِ وَالعَمَلَ بِهِ، فَلَيْسَ لِلّٰهِ حَاجَةٌ فِىْ أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُগ্ধ.
“আর যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কাজ ছাড়তে পারল না, তার খানা-পিনা পরিত্যাগে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।”[৮]
সিয়ামের মাধ্যমে তাক্বওয়ার চর্চা যেভাবে হয় :
০১. সিয়ামের পর্যবেক্ষক কেবল মহান আল্লাহ। বান্দাহ যেভাবে মহান আল্লাহকে খুশী করার জন্য সিয়াম পালন করে, তেমনি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সর্বাবস্থায় তাঁকে ভয় করে চলার শিক্ষা লাভ করে। ফলে তাক্বওয়া অর্জিত হয়।
০২. প্রবৃত্তির লালসা মানুষকে নাফরমানীর দিকে ধাবিত করে। আর সিয়াম এই লালসার মহৌষধ। সে কারণে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লাম) বিবাহে আর্থিক অসর্থদের সিয়াম পালনের নির্দেশ দেন।[৯]
তাছাড়া রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লাম) সিয়ামকে নাফরমানী হতে বক্ষাকারী ঢাল হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।[১০]
০৩. মানুষকে প্রবৃত্তির লালসায় বিভ্রান্ত করার প্রধান শত্রু হলো অভিশপ্ত ইবলীস। রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লাম) বলেন : ইবলীস মানুষের রক্তনালী দিয়ে প্রবেশ করে।[১১]
সিয়াম পালন করলে স্বাভাবিকভাবে রক্তনালী সংকোচিত হয়ে যায়। ফলে ইবলীস সহজে প্রবেশ করে বিভ্রান্ত করতে পারে না। আর এ সুবাদে মানুষ তাক্বওয়ার যথাযথ অনুশীলন করতে সক্ষম হয়।
দাসের শিক্ষাসমূহ-
০১. সিয়াম আত্মশুদ্ধি অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ। তাই এ বিধান মহান আল্লাহ বিগত সকল জাতির প্রতি আরোপ করেন।
০২. উম্মাতে মুহাম্মাদীর উপর রামাযান মাসের সিয়াম র্ফয। আর এ র্ফয পালনের মাধ্যমে একজন মুসলিম প্রকৃত মানবতার শিক্ষা লাভ করতে পারে।
০৩. রামাযান নেকীর প্রতিযোগিতার উর্বর সময়। এর মাধ্যমে মানুষ সংযমশীলতার শিক্ষা লাভে ধন্য হয়।
০৪. সংজ্ঞা পূরণের নাম সিয়াম নয়; বরং প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল প্রকার নাফরমানী ও হারাম থেকে বেঁচে থাকার নাম প্রকৃত সিয়াম।
০৫. তাক্বওয়ার অনুশীলন সত্য সন্ধানী মানুষের একান্ত কাম্য। যাঁরা মুত্তাক্বী, তাঁরাই মহান আল্লাহর প্রকৃত বান্দা। আর মুত্তাকীদের জন্য নির্মিত হয়েছে জান্নাত।
০৬. মাহে রামাযানের সম্মানার্থে দিনের বেলা হোটেল, রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখি এবং যাবতীয় অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা বন্ধ করতে সচেষ্ট হই।
তাই আসুন! আমরা আসন্ন রামাযানকে স্বাগত জানাই। ‘ইবাদত-বন্দেগী করার মানষিক প্রস্তুতি গ্রহণ করি। যাবতীয় হারাম ও অশ্লীল কাজ বর্জন করি। প্রকৃত মানুষ হয়ে আর্তমানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ করি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সেভাবে কবুল করুন -আমীন। (পুনঃপ্রকাশ)

[১] আল কুরআন : সূরা আল বাক্বারাহ্ ২ : ১৮৩।
[২] ড. ওয়াহবা আল-যুহায়লী, আল-তাফসীর আল মুনীর, দারুল ফিকর- দামেশক, ১/৪৯৪, আল মিশবাহুল মুনীর- দারুস সালাম, রিয়াদ, ১৩০।
[৩] ফতহুল বারী- ৮/২৬, সহীহ মুসলিম- ২/৭৯২।
[৪] শায়খ ‘আবদুর রহমান আল-সা’আদী। তাইসীরুল কারীমির রহমান” মুয়াস্ সামাতুর রিসালাহ- বাইরুত/৮৬।
[৫] ইবনু রজব “জামিউল উলুমি ওয়াল হিকাম- ১/৪০০।
[৬] ইমাম কুরতুবী- আল জামিউ লি আহকামিল কুরআন, ১/২৭৬।
[৭] ইবনু রজব- জামিউল উলূমি ওয়াল হিকাম, ৪০০।
[৮] সহীহুল বুখারী- হা: ১৭৭০, ১৯০৩।
[৯] সহীহুল বুখারী “ফাতহুল বারী”- ৯/৮, মুসলিম- ২/১০১৮।
[১০] সহীহুল বুখারী- হা: ১৮৯৪, সহীহ মুসলিম- হা: ১১৫১।
[১১] ইমাম বাহভী ‘শারহুস সুন্নাহ’- ১৪/৪০৫।

আপনার মন্তব্য1

ঢাকায় সূর্যোদয় : 5:57:40 সূর্যাস্ত : 5:30:17

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত